প্রাথমিকে সাঁওতালি মাধ্যমের দাবি

সকালে বাড়ির খুদে সদস্যকে পড়াতে বসেছিলেন দাদু। নাতিকে বলেন, ‘‘আমাদের ভাষায় ‘নাপায় সেতাঃ’ লেখ দেখি।’’ কলম নামিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে খুদে। শব্দটার অর্থ ‘সুপ্রভাত’ সে জানে। কিন্তু অলচিকি হরফে লিখবে কী ভাবে!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কাটোয়া শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৭ ০০:২৩
Share:

সকালে বাড়ির খুদে সদস্যকে পড়াতে বসেছিলেন দাদু। নাতিকে বলেন, ‘‘আমাদের ভাষায় ‘নাপায় সেতাঃ’ লেখ দেখি।’’ কলম নামিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে খুদে। শব্দটার অর্থ ‘সুপ্রভাত’ সে জানে। কিন্তু অলচিকি হরফে লিখবে কী ভাবে!

Advertisement

দৃশ্য দুই: ‘জেঁড়ে ক ক তের তের...’ উৎসাহের সঙ্গে আবৃত্তি করে খুদে। কিন্তু শিক্ষক মহাশয়ের বুঝতে বেশ সময় লাগে, ওটা মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বিখ্যাত ‘পাখি সব করে রব’-এর সাঁওতালি তর্জমা।

বর্ধমানে প্রাথমিক স্তরে ‘সাঁওতালি’ মাধ্যমে পড়ার সুযোগ না থাকায় দু’রকম সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের একাংশের। প্রথমত, বাড়িতে সাঁওতালিতে কথাবার্তা হলেও অলচিকি অক্ষরজ্ঞানই হচ্ছে না আদিবাসী পরিবারের ছাত্রদের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, আদিবাসী অধ্যুষিত স্কুলগুলিতে শিক্ষকেরাও সাঁওতালি ভাষার ব্যবহার সেভাবে না করায় সেই সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে।

Advertisement

প্রশাসনের সূত্রে জানা গিয়েছে, কাটোয়ার সুড্ডো, শিয়ালডাঙা, খেদাপাড়া, সাঁতপুকুর, শ্রীখণ্ডের বাগটোনা, ডাকবাংলা-সহ জেলার বহু প্রান্তে সাঁওতালি ভাষাভাষী মানুষ রয়েছেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের বেশির ভাগই অলচিকিতে লিখতে জানেন না। কেন এমন হাল?

জানকীলাল শিক্ষা সদনের শিক্ষক শুকলাল হেমব্রম, চণ্ডী হাঁসদাদের আক্ষেপ, ‘‘যে ভাষা স্কুলেই শেখানো হচ্ছে না, সেই ভাষার ব্যবহার নিয়ে অনীহা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।’’ কিন্তু এর ফলে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি শিক্ষক মহলের একাংশের।

মাস খানেক আগে জেলা পরিষদের তরফেও জানানো হয়, জেলার ১৩৫টি আদিবাসী স্কুলে ছাত্রদের পড়া বোঝাতে সাঁওতালির তুলনায় বাংলা ভাষাই বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়ছে পড়ুয়ারা। এমনকী ‘ভাষা-ভীতি’তে স্কুলছুটের সংখ্যাও নেহাত কম নয় বলে দাবি শিক্ষা মহলের একাংশের। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, ভাষাবিদ পবিত্র সরকারও মনে করেন, প্রাথমিক স্তরে পরিভাষা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয় পড়ুয়াদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাতৃভাষা ব্যবহার না করলে সেই ধারণাগুলি স্পষ্ট হয় না, যা ভবিষ্যতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

সম্প্রতি জেলা পরিষদের সভাধিপতি দেবু টুডু আদিবাসী এলাকার একটি স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের ক্লাসে সাঁওতালি ভাষা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয়নি বলে দাবি চণ্ডীবাবুদের।

জেলায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সাঁওতালি ভাষায় পঠনপাঠন হলেও প্রাথমিক স্তরে তা শুরু হয়নি বলে দাবি ‘আদিবাসী সমাজ শিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক সংস্থা’ নামে একটি সংগঠনের। ওই সংস্থার রামদাস কিস্কু বলেন, ‘‘রাজ্যে ৩২টি স্কুলে সাঁওতালি মাধ্যম স্কুল রয়েছে। বর্ধমানে তা চালুর জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি ও জেলা স্কুল পরিদর্শককে একাধিকবার আবেদন জানিয়েছি।’’

বিষয়টি মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নজরে আনার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি অচিন্ত্য মল্লিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন