বাইরে পা রেখে ছক ভেঙে বাঁচা

ঘরবন্দি থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। কয়েকজনের উৎসাহে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয়। আর তাতেই ভাগ্য গেল খুলে। পূর্ব বর্ধমানের গুসকরার ডোকরা শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে লিখছেন সৌমেন দত্তরামুবাবুর ছেলে শুভ কর্মকার বছর তিনেক আগে দেরিয়াপুর ছেড়ে কলকাতার মিলন মেলা প্রাঙ্গণে ‘ডোকরা শিল্প’ নিয়ে পা রাখেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

সৃষ্টি: ডোকরার দুর্গামূর্তি। নিজস্ব চিত্র

ঘরবন্দি না থেকে বাইরে পা রাখা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেনা ছক ভেঙে এগনো। এই দুইয়ের মিশেলে বাজারে চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে ‘ডোকরা’র। আর তারই দৌলতে ধীরগতিতে হলেও দেরিয়াপুরের আর্থিক অবস্থানটাও বদলাতে শুরু করেছে।

Advertisement

গুসকরার কাছে দেরিয়াপুরে পাঁচ দশক ধরে পঁচিশ ঘর বাসিন্দার হাত ধরে জেলার কুটিরশিল্প মানচিত্রে ঠাঁই রয়েছে ডোকরা শিল্পের। গ্রামের শম্ভু কর্মকার ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। এর ২০ বছর পরে ১৯৮৬ সালে হারাধন কর্মকার, ১৯৮৮ সালে মটর কর্মকার ও বৈকুণ্ঠ কর্মকার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১২ সালে রামু কর্মকারও রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। তার পরেও দেরিয়াপুরের শিল্পীদের আর্থিক দৈন্যদশা কাটেনি। বরং নতুন প্রজন্ম ওই শিল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। সে সময় শিল্পীদের আয় নেমে এসেছিল বছরে গড়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকায়। রামুবাবুর কথায়, “কোনও দিন কোদাল ধরিনি। আমাদেরও সেই কোদাল ধরে ১০০ দিনের কাজে যেতে হয়েছে। ইদানিং অবশ্য অবস্থাটা পাল্টেছে।”

কী ভাবে?

Advertisement

রামুবাবুর ছেলে শুভ কর্মকার বছর তিনেক আগে দেরিয়াপুর ছেড়ে কলকাতার মিলন মেলা প্রাঙ্গণে ‘ডোকরা শিল্প’ নিয়ে পা রাখেন। মেলায় বিক্রির হার দেখে উৎসাহিত হয়ে ওই বছরেই গোয়া কার্নিভালে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানেও সাফল্যে মেলে। তাঁর কথায়, “মেলার মাধ্যমে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হই। অন্য শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। তাঁদের চাহিদা বুঝে শিল্পকর্ম তৈরি করি। এখন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ পেতে অসুবিধা হচ্ছে না।” তাঁর দাবি, “আমাকে দেখে দেরিয়াপুরের অনেক যুবক উৎসাহিত হয়ে বাইরের দুনিয়াতে পা রাখছেন। মেলায় গিয়ে নিজেদের শিল্পকর্ম তুলে ধরছেন।” সম্প্রতি শুভ ডেনমার্ক ঘুরে এসেছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দা সুভাষ মণ্ডল ‘ডোকরা শিল্প’ নিয়ে মাস তিনেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, “দেশের মধ্যে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, গোয়াতে ডোকরা শিল্পের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া, বিদেশের বাজারেও ডোকরা নিয়ে উৎসাহ রয়েছে অনেকের। আমাদের বিপণনে ঘাটতি ছিল। এখন সেই দূরত্ব কমতে শুরু করেছে।”

অভিনব: দেরিয়াপুরের এমন কাজ ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র

গ্রামের যুবক গৌরাঙ্গ কর্মকার, রাজেশ কর্মকারদের কথায়, “আগে মহাজনরা যা বরাত দিতেন, আমরা তা-ই তৈরি করতাম। বাইরে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, ঠিক কীসের চাহিদা রয়েছে।” তাঁরা জানান, ‘কানা গলি’তে হারিয়ে যাওয়া থেকে ডোকরা শিল্পকে বাঁচানোর জন্য রাজ্য সরকারের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। রাজ্য সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর, ‘খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ’ যৌথ ভাবে দেরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। শিল্প রীতির প্রশিক্ষণ হচ্ছে। বিদেশের বাজার ধরার জন্য দেরিয়াপুরের শিল্পীদের ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শেখানো হচ্ছে। আর বোঝানো হচ্ছে, অচেনা-বাজার ধরতে গেলে শিল্পকর্মের পরিসরটা কী ভাবে বাড়াতে হয়।

ডোকরা শিল্প মানেই দেবদেবীর মূর্তি, পুজোর সরঞ্জাম আর হাতি-ঘোড়া। বড়জোর ঘর সাজানোর কিছু মূর্তি—এই ছিল ‘চেনা গণ্ডি’। তবে দেরিয়াপুরের শিল্পীরা এখন সে ছক ভেঙেছেন। তাঁদের ভাঁড়ারে অনেক নতুন জিনিস সংযোজিত হয়েছে, যা আকৃষ্ট করছে দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের। যেমন—জামাকাপড় টাঙানোর হ্যাঙার থেকে ক্লিপ, বোতাম—সবেতেই ঢুকে পড়েছে ডোকরা। কানের দুল, বালা, চাবির রিং দেদার বিক্রি হচ্ছে। রুচিশীল ক্রেতারা বাড়ির জন্য গ্রিল থেকে শুরু করে দরজার কড়া তৈরির জন্য ডোকরা শিল্পীদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। সাবানদানি থেকে পেপারওয়েটও কম তৈরি হচ্ছে না।

শিল্পীরা জানাচ্ছেন, এ দেশে ছত্তীসগঢ়ের বস্তার এই শিল্পের আঁতুরঘর। কোন বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বস্তার ছেড়ে বেশ কিছু পরিবার ‘কাজের খোঁজে’ পুবে পা বাড়ায়। তাঁদেরই একটা অংশ নানা প্রান্ত ঘুরে ঠাঁই নিয়েছিল গুসকরা থেকে চার কিলোমিটার দূরে দেরিয়াপুরে। ‘দরিয়াপুর ডোকরা আর্টিজানস কো-অপারেটিভ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি লিমিটেড’-র সভাপতি সুভাষ মণ্ডল বলছিলেন, “কাজের খোঁজ করতে এসে দেরিয়াপুরে বসবাস শুরু করেছিলেন শিল্পীরা। কয়েক বছর আগেও এখানকার শিল্পীরা মাথায় বাক্স নিয়ে ঝালাইয়ের কাজ করতেন। সরকারের দৃষ্টি পড়তে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি।” ওই সংস্থার দাবি, বিদেশি পর্যটকদের একটা বড় অংশ নিজের চোখে কাজ দেখে শিল্পকর্ম কিনতে পছন্দ করেন। সে জন্যই সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুজোর পরে গ্রামেই ‘ডোকরা মেলা’ করা হয়। বাড়ি-বাড়িতে শিল্পকর্ম তৈরির প্রদর্শশালাও খোলা থাকে। খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদের জেলার কর্তা অনুপ দে বলেন, “দেরিয়াপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে শান্তিনিকেতন। সেখানকার পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যেও শিল্পকর্মের প্রদর্শশালা তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া হয়।”

পরিবারের মহিলারাই মূলত ‘ডোকরা শিল্প’ তৈরির প্রারম্ভিক কারিগর। তাঁরাই ছাঁচের উপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া, পিতল গলানো থেকে নানা রকম কাজ করে থাকেন। রিনা কর্মকার, মায়া কর্মকার, ফুলটুসি কর্মকারদের কথায়, “তিন বছর ধরে শীতকালে দম ফেলার সুযোগ পাই না। এই সময় প্রচুর কাজের বরাত থাকে। মেলায় বেচার জন্য নতুন নতুন ডিজাইনের শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়।” ধনতেরসের সময়েও শিল্পীদের বাড়ি থেকে ডোকরা কেনার উৎসাহ বাড়তে শুরু করেছে। এখন অনেক শিল্পীর মাসিক আয়ই দাঁড়িয়েছে গড়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকায়।

শুভর দেখানো পথে গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন দেরিয়াপুরের ডোকরা-শিল্পীরা।

সাত দিনে সাত কাহনের বিভিন্ন বিভাগে ই-মেল বা চিঠি পাঠাতে:

ই-মেল: edit.southwestbengal@abp.in
চিঠি: আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
চিঠি বা ই-মেলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাম উল্লেখ করতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন