চন্দ্রচূড় মন্দিরে। —নিজস্ব চিত্র।
চৈত্রের শেষবেলায় শুরু হওয়া গাজন উৎসবের রেশ থাকল নববর্ষের সারা দিন। কোথাও পঙ্ক্তিভোজ, কোথাও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান —শিল্পাঞ্চল জুড়ে দেখা মিলেছে গাজনের বিভিন্ন মেজাজ। মেলা দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
আসানসোল গ্রামের গাজনের মেলা এলাকায় অন্যতম প্রাচীন উৎসব বলে পরিচিত। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এই পুজোর বয়স প্রায় ৩০৭ বছর। এই পুজো কমিটির সভাপতি শচীন রায় জানান, আসানসোল গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সর্ম্পকে দুই ভাই নকড়ি রায় ও রামকৃষ্ণ রায় এই গাজন শুরু করেছিলেন। উদ্যোক্তারা জানান, গাজন উপলক্ষে ছিল পঙক্তিভোজের ব্যবস্থা। রয়েছে যাত্রা। স্থানীয় বাসিন্দা বাবুয়া চৌধুরী, অরুণ সেনগুপ্তরা জানান, এই উৎসব তাঁদের কাছে যেন মিলন মেলা। আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাও এখানে যোগ দেন। আসানসোল গ্রামের পাশেই রয়েছে বুধাগ্রাম। সেখানে ১৯৭৭ সাল থেকে চলছে গাজনের মেলা। এই গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা বিজয়কুমার হাজরা জানান, স্থানীয় বুধা শিবমন্দিরে আগে শিব পুজো শুরু হয়েছিল। তার অনেক বছর পরে গাজন শুরু হয়েছে। এখানে গাজনের মূল আকর্ষণ হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তারা জানান, এখানে গাজনের মঞ্চে গ্রামের অনেক খুদে প্রথম অনুষ্ঠান করার সুযোগ পায়। নববর্ষের রাতে এখানে ছিল পঙক্তিভোজের ব্যবস্থা। জামুড়িয়ার সাতগ্রামের গাজনের মেলার বয়স ৫০০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। আয়োজক সংস্থার প্রবীন সদস্য স্বপন রজক জানান, ১১ এপ্রিল থেকে উৎসব শুরু হয়েছে। রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আসানসোল উত্তর এলাকার সুইডি মৌজায় চন্দ্রচূড় মন্দিরের গাজন শিল্পাঞ্চলে অন্যতম জনপ্রিয়। সুইডি, মরিচকোটা ও রঘুনাথবাটি এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে তৈরি চন্দচূড় মন্দির সুসংস্কার কমিটি এই গাজন পরিচালনা করে। কমিটির যুগ্ম সম্পাদক যুধিষ্ঠির মণ্ডল জানান, জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, অনেক দিন আগে রামশরণ চক্রবর্তী নামে এলাকার এক বাসিন্দা লাঙল হাতে নিজের জমিতে চাষ করতে গিয়েছিলেন। মাটি কোপানোর সময়ে তাঁর লাঙলের ফলার সঙ্গে একটি শিলাপাথরের ধাক্কা লাগে। পরে বাড়ি ফিরে রাতে তিনি শিবকে স্বপ্নে দেখেন। যুধিষ্ঠিরবাবুর দাবি, শিব রামশরণবাবুকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে ওই শিলাপাথর তুলে এনে পুজো করতে বলেন। এর পর তিনি মাঠ থেকে ওই শিলা তুলে আনেন। তৈরি হয় ছোট মন্দির। কয়েকদিন পরে কাশিমবাজারের তৎকালীন রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর নায়েব তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ওই শিবমন্দিরে নিয়ে যান। তারপর স্ত্রী সুস্থ হয়ে যায় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এরপর মণীন্দ্রচন্দ্রবাবু ওই এলাকায় টিনের ছাউনি দেওয়া একতলার কংক্রিটের মন্দির তৈরি করে দেন। উদ্যোক্তারা জানান, ১৯৩৫ সালে সুইডি, মরিচকোটা ও রঘুনাথবাটির বাসিন্দারা মিলে একটি কমিটি গঠন করে পুরনো মন্দির ভেঙে নতুন মন্দির তৈরি করেন। সেই মন্দিরই এখন চন্দ্রচূড় মন্দির নামে পরিচিত। এখানে এক সপ্তাহ ধরে গাজনের মেলা চলে। তার পরেও থাকে ভাঙা মেলা।
গাজন শেষ হয়ে গিয়েছে। তবে জনপ্রিয় এই লোক উৎসবের রেশ এখনও শিল্পাঞ্চলের আনাচে কানাচে।