বানে ভেসেছে বাড়ি, বৌভাত ত্রাণশিবিরে

বিয়েটা প্রায় ভেসেই যাচ্ছিল। বানভাসি বর ত্রাণশিবিরে। কনের বাড়িতে জল ওঠেনি বটে, কিন্তু বর ছাড়া বিয়েই বা কী করে হয়! কবেই হলুদে ছোপানো কার্ড চলে গিয়েছে আত্মীয়দের বাড়ি। বেনারসী, ধুতি-পাঞ্জাবি কেনাকাটাও শেষ। কে তখন জানত, শ্রাবণ এমন অঝোর হবে, আর ফুলে উঠবে নদী?

Advertisement

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৫ ০২:৩২
Share:

পূর্বস্থলীর ত্রাণশিবিরে নবদম্পতি। ছবি: মধুমিতা মজুমদার।

বিয়েটা প্রায় ভেসেই যাচ্ছিল।

Advertisement

বানভাসি বর ত্রাণশিবিরে। কনের বাড়িতে জল ওঠেনি বটে, কিন্তু বর ছাড়া বিয়েই বা কী করে হয়!

কবেই হলুদে ছোপানো কার্ড চলে গিয়েছে আত্মীয়দের বাড়ি। বেনারসী, ধুতি-পাঞ্জাবি কেনাকাটাও শেষ। কে তখন জানত, শ্রাবণ এমন অঝোর হবে, আর ফুলে উঠবে নদী?

Advertisement

হায়দরাবাদে রান্নার কাজ করেন মধ্য তিরিশের স্বপন দাস। বর্ধমানের পূর্বস্থলীতে দক্ষিণ শ্রীরামপুর গ্রামের বাড়িতে এ বার তিনি ফিরেইছিলেন কাঞ্চন দেবনাথের সঙ্গে ঘর বাঁধবেন বলে। কিন্তু নিজের ঘরই ভেসে গেল! নৌকায় ভেসে এসে উঠলেন একটি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কার্যালয়ে খোলা ত্রাণ শিবিরে।

এই অবস্থায় কে আর বিয়ে করতে যাওয়ার কথা ভাববে? কিন্তু কনের বাড়ির বিশ্বাস, বিয়ের দিন পিছোলে ঘোর অমঙ্গল! সুতরাং কোনও রকমে ছাতা-জুতো সামলে সোমবার বিয়ে করতে গিয়েছিলেন স্বপন। বউ নিয়ে ফেরেন ত্রাণ শিবিরেই। হিসেব মতো বুধবার তাঁদের বৌভাত। কিন্তু... ত্রাণ শিবিরে বৌভাত! ভোজবাড়ি!

সকাল থেকেই মুখ কালো করে ঘুরছিলেন কাঞ্চন। তা দেখে শিবিরেও অনেকের মনখারাপ। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের কানেও কথাটা ওঠে। সকালে পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক পরিস্থিতি দেখতে এলে তাঁর কাছেই বৌভাত করার আর্জি জানান তাঁরা। নিজেরাও সাধ্য মতো সাহায্য করবেন বলে জানান। রাজি হয়ে যান দিলীপবাবু আর তড়িঘড়ি বৌভাতের আয়োজনে নেমে পড়ে পঞ্চায়েত সমিতি। ব্লক অফিসের কর্মীরাও নেমে পড়েন।

শিবিরেরই একটি ঘরে পাতা হয় কাঠের চৌকি। ফুল দিয়ে সাজানো হয় গোটা ঘর। কনে সাজাতে লোকও ডাকা হয়। কাছেই আরও দুই ত্রাণ শিবিরে নৈশভোজের আমন্ত্রণ যায় — সব মিলিয়ে তিনশোরও বেশি বন্যাদুর্গত মানুষ। প্রত্যেকটি পরিবার পায় নতুন শাড়ি। মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ এসে বরকে সাইকেল আর কনেকে তাঁতযন্ত্র উপহার দিয়ে যান। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দলনেত্রী সবিতা মজুমদার, সুতপা দেবনাথেরা বলেন, ‘‘শিবিরের মধ্যেও ওদের কিছুটা খুশি ফিরিয়ে দিতে পেরে ভাল লাগছে। প্রত্যেকের কাছেই স্মরণীয় হয়ে রইল দিনটা। ’’

পাতে কী পড়ল?

ভাত, ডাল, আলুভাজা, আলু-পটলের তরকারি, মাছের কালিয়া, পাঁপড়, চাটনি এবং শেষ পাতে দই।

যা পেয়ে বহু দিন পরে জুত করে খেয়ে আঙুল চেটেছেন প্রায় সকলেই। এমনিতে শিবিরে খাবার বলতে তো রোজ দুপুরে খিচুড়ি বা ভাত-ডাল-সব্জি আর রাতে চিঁড়ে-মুড়ি। তাতে প্রাণধারণ করা যায় ঠিকই, কিন্তু মন ওঠে না। গত দিন দশেক ধরে শিবিরে থাকা অনিতা বা স্বপ্না অধিকারীরা বলেই ফেলেন, ‘‘রোজ একই খাবার খেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। বিয়েবাড়ি হবে, কে ভেবেছিল!’’

স্বপন-কাঞ্চনও কি ভেবেছিলেন?

লাজুক মুখে নবদম্পতি বলেন, ‘‘বিয়েটাই তো ভেস্তে যাচ্ছিল। তা না হয় এক রকম করে মিটেছে। কিন্তু যে ভাবে এত মানুষকে নিয়ে হইচই করে বৌভাত হল, বাড়িতে হলেও হয়তো এত আনন্দ হত না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন