কেতুগ্রামের নবগ্রামের বালি খাদান। নিজস্ব চিত্র
একের পর এক প্রশাসনিক বৈঠকে বেআইনি বালি খাদানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কালনার সভা থেকেও যে দিন তিনি সেই বার্তা দিলেন, সে দিনই জেলায় খাদানে অভিযানে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়লেন ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিকেরা।
শুক্রবার কালনায় প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বালি খাদান, কয়লা মাফিয়াদের কড়া হাতে মোকাবিলা করার জন্য পুলিশকে বলছি।’’ বৃহস্পতিবার দুর্গাপুরে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বেআইনি খাদান বন্ধ করতে ক়ড়া পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর এমন নির্দেশের পরেই কেতুগ্রামের নবগ্রামে অজয়ে একটি বালিঘাট পরিদর্শনে গিয়ে এলাকার কিছু লোকজনের ক্ষোভের মুখে পড়লেন আধিকারিকেরা।
কেতুগ্রাম ২ ব্লকের নবগ্রামে অজয়ের বালির চরে পরিদর্শনে যান কাটোয়া মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক বীরেন্দ্রনাথ দাস, ব্লক ভূমি আধিকারিক শ্যামল সরকার। নবগ্রামের মাঠকালীতলা ঘাটের কাছে গিয়ে তাঁরা দেখেন, চর থেকে প্রচুর বালি তোলা হয়েছে। মাঝ নদীতে বালতি-কোদাল দিয়েও বালি তোলা হয় বলে খবর ছিল প্রশাসনের কর্তাদের কাছে। রাস্তায় ট্রাকের চাকার ছাপ দেখা গেলেও এ দিন কোনও খননকারীকে দেখতে পাননি কর্তারা। কিন্তু তাঁদের ঘিরে ধরে কিছু লোকজন দাবি করেন, এই ঘাট থকে তোলা বালি বাইরে বিক্রি নয়, এলাকার মানুষের বাড়ি তৈরিতে লাগে।
স্থানীয় বাসিন্দা সূর্যকান্ত মাজি, বাবলু সূত্রধরেরা বলেন, ‘‘বর্ষা এলেই নদী আমাদের জমি-বাড়ি সব ভাসিয়ে দেয়। এখন পাকা বাড়ি করতে যা খরচ পঞ্চায়েত থেকে দেওয়া হচ্ছে, সেই টাকায় বালি কিনে বাড়ি তৈরি সম্ভব নয়।’’ বালি তুলতে দেওয়ার জন্য আগেও প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন বলে দাবি ব্রজগোপাল ঘোষ, চন্দ্রকান্ত মাজিদের। বিএলএলআরও শ্যামলবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘ঘাট থেকে ট্রাক বেরোনোর রাস্তা নেই। পরিবেশ উপযুক্ত না হওয়ায় এই ঘাটের বৈধকরণ এখন সম্ভব নয়।’’
বেআইনি খাদানের সমস্যা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অতিরিক্ত বালি বোঝাই ট্রাকের দাপট। রাতে বাকলসা, শ্যামবাজার, বকুলিয়া, বাঁশতলা ঘাট থেকে অতিরিক্ত বালি তুলে ট্রাক যাতায়াত করে বলে অভিযোগ। এ দিনই বাঁশতলা ঘাট থেকে বেশি বালি নিয়ে যাওয়ায় একটি ট্রাককে জরিমানা করেন ভূমি দফতরের কর্তারা। জুনের মাঝামাঝি থেকে চার মাস বালি তোলায় প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তখন নদীর মাঝে বালতি দিয়ে বালি তুলতে দেখা গিয়েছে কেতুগ্রামের বেগুনকোলা ও কাটোয়ার গোয়াইয়ে অজয়ের ঘাটে, অভিযোগ বাসিন্দাদের।
মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক বীরেন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘অনিয়ম দেখলে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ জানানো হয়। মঙ্গলকোটের নবগ্রাম ও তেওড়সা ঘাটে অবৈধ খননের জন্য সম্প্রতি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। প্রতি ঘাটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হয়। কেতুগ্রামের নারেঙ্গা ও মঙ্গলকোটের সাগিরা-সহ আরও চারটি ঘাটকে বৈধকরণ করার আইনি প্রক্রিয়া চলছে।’’
দামোদরে গলসি থেকে জামালপুরেও বালি মাফিয়াদের দাপট নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে বাসিন্দাদের। গলসির কাছে একটি গ্রামে অতিরিক্ত বালি বোঝাই ট্রাকের দাপট রুখতে পথে নেমেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মেমারিতে একই বিষয় নিয়ে পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের গোলমাল বেধেছে সম্প্রতি। বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, জেলা প্রশাসন খাদানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর কথা বললেও, তা দেখা যায় না। নদীর পাড় থেকে ২০০ মিটার দূরে বালি তোলার কথা থাকলেও, তা মানা হয় না। নদীর পাড়ে কোন জায়গা থেকে বালি তোলা হবে, তার নির্দিষ্ট মাপ করে দেওয়ার নিয়ম বিএলএলআর দফতরের। কিন্তু কোথাও তা থাকে না বলে ইজারাদারদের একটি বড় অংশ ইচ্ছেমতো বালি তোলেন বলে অভিযোগ। বালির গাড়ি যাতায়াতের জন্য বাঁধ ও রাস্তার অবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছে বলে ক্ষোভ বাসিন্দাদের।
জেলা প্রশাসনের অবশ্য দাবি, বেআইনি বালি খাদানগুলি চিহ্নিত করে নিলামে তোলা হয়েছে। গত আর্থিক বছরে ৬৮টি বেআইনি বালি খাদান চিহ্নিত করে ৮০ কোটি টাকা রাজস্ব মিলেছিল। এ বছর আরও কয়েকটি খাদান চিহ্নিত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের হিসেবে, গত বছর এই সময় পর্যন্ত ৩৪টি অভিযান চালিয়ে ৪৯টি গাড়ি আটক করেছিল প্রশাসন। সাড়ে ১১ লক্ষ টাকার বেশি জরিমানা আদায় হয়েছিল। এ বছর ১২৫টি অভিযানে প্রায় এক কোটি ৭১ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। আটক হয়েছে ৫৯৯টি গাড়ি। জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতো বেআইনি বালি খাদান ও অতিরিক্ত বালি বোঝাই আটকাতে অভিযান চলবে।’’