তুবড়ির লড়াইয়ে মর্ত্যে আসেন লক্ষ্মী

কালী মন্দিরকে ঘিরেই গ্রামের নাম কালীবেলে। অথচ গ্রাম উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে লক্ষ্মীপুজোয়।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৫২
Share:

চলছে বাজি তৈরি। নিজস্ব চিত্র।

কালী মন্দিরকে ঘিরেই গ্রামের নাম কালীবেলে। অথচ গ্রাম উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে লক্ষ্মীপুজোয়।

Advertisement

তাও আবার শুধু পুজো নয়, বাজি আর তুবড়ি লড়াইয়ের সঙ্গে মর্ত্যে আসেন দেবী। সঙ্গে থাকে গ্রাম জুড়ে আলোর রোশনাই।

সাধারণত খেতজমি থেকে ফসল নির্বিঘ্নে ঘরে তোলার আর্জি নিয়ে লক্ষ্মীপুজো হয়। সঙ্গে থাকে সারা বছর সংসারে লক্ষ্মী অচলা থাকার প্রার্থনা। তবে মেমারির সাতগেছিয়া ২ পঞ্চায়েতের কালীবেলে গ্রামে লক্ষ্মীপুজোর চল হয়েছিল অন্য ভাবে।

Advertisement

গ্রামবাসীদের দাবি, পূর্ব পাড়ার বেশ কয়েকঘর বাসিন্দা তুবড়ি বানাতেন। মূলত দুর্গাপুজোর সময় তা বিক্রি হতো। আবার চাহিদা বাড়ত কালীপুজোয়। ফলে বাজি কারিগরেরা নিজেরা বাজি ফাটানোর সুযোগ পেতেন না। আনন্দও করতে পারতেন না সেভাবে। তাই মায়ের বিসর্জনের পরে মেয়ের পুজোতেই মেতে উঠতেন তাঁরা। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা উদয়চাঁদ মুখোপাধ্যায়, শচীন মুখোপাধ্যায়রা বলেন, “তুবড়ি ফাটানোর নেশায় অন্য পাড়ার বাসিন্দারাও কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় মেতে উঠতে লাগলেন। সময়ের সঙ্গে কোজাগরী গ্রামের উৎসবে পরিণত হয়ে গেল।” মধ্যম পাড়ার গোপেশ্বর ঘোষও বলছিলেন, “আগে বাড়িতে বাড়িতে কোজাগরীর আরাধনা হত। এখন বাড়ির পুজো বন্ধ করে আমরা একজোট হয়ে লক্ষ্মীপুজো করি। যাতে অন্য পাড়ার সঙ্গে টক্কর দিতে পারি।”

জানা যায়, একটা সময় বাড়ির দরজায় কার্তিক ফেলে যাওয়ার মতো এই গ্রামে লক্ষ্মী ফেলার চল ছিল। জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ বাগরা জানান, তখনও বারোয়ারি পুজো জমেনি। সেই সময় দুর্গাপুজোর পর একটু অবস্থা ভাল পরিবারে প্রসাদ খাওয়ার লোভে লক্ষ্মী প্রতিমা ফেলে দেওয়া হতো। এখন অবশ্য সেই চল আর নেই। বারোয়ারি পুজোতেই আনন্দে মাতেন গ্রামের মানুষ।

চল্লিশ বছরেরও বেশি গ্রামে এ রেওয়াজ চলছে। এখন সাতটি বারোয়ারি পুজো হয়। প্রতিমা বা মণ্ডপ তৈরির ক্ষেত্রে নতুনত্বের ছোঁয়া না থাকলেও মূল আকর্ষন আলোর রোশনাই। আর বিসর্জনের রাতে ‘কদম গাছ’ (গাছের মতো কাঠামো করে বাজি দিয়ে সাজানো হয়) পোড়ানো। এই কদম গাছ কারা, কতগুলো করছে, নতুনত্ব কিছু থাকছে কি না, তার উপরেই নির্ভর করে পুজো উদ্যোক্তাদের প্রশংসার ভাগ্য। বিসর্জনের পথেও নানা রকম বাজি ফাটানো হয়। বাড়িতে ভিয়েন বসানোর মতো শব্দহীন বাজি পুজো উদ্যোক্তারা নিজেদের এলাকাতেই তৈরি করেন। পুজো উদ্যোক্তাদের দাবি, প্রত্যেক পুজোয় ২-৩ টে কদম গাছ তৈরি করে। এ ছাড়াও শব্দ ও শব্দহীন বাজির ছড়াছড়ি থাকে। সব মিলিয়ে বিসর্জনের রাতে প্রায় দু’লাখ টাকার বাজি ফাটানো হয় বলেও তাঁদের দাবি।

গ্রামের যুবক শচীন ঘোষ, পরেশ পাল, বিশ্বজিৎ প্রামাণিকদের কথায়, “বিসর্জনের দিন রাত ১০টা থেকে কদম গাছ পুড়তে থাকে। বাজি ফাটানো দেখতে রাতভর রাস্তায় লোক থাকে।” এর পাশাপাশি গ্রামের মানুষরা নিজেদের উদ্যোগে নাটক-যাত্রা করেন। এখন শেষ মূ্হুর্তে তার প্রস্তুতি চলছে। পুজো থেকে দূরে থেকেও সুশান্ত ক্লাবের সদস্যরা বেশ কয়েক বছর ধরে যাত্রা করে থাকেন। যাত্রার মহড়া দেওয়ার ফাঁকে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় দাবি করেন, “আমাদের আর্থিক অবস্থা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে যায়। তখন বাবা স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীর পুজো শুরু করেছিলেন।” গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের দাবি, মুখোপাধ্যায় পরিবারেই দেবী প্রতিমা নিয়ে এসে পুজোর প্রচলন করেন।

গ্রামে মেলা বসতে শুরু করে দিয়েছে। আসতে শুরু করেছেন আত্মীয়েরা। উৎসাহ-উদ্দীপনা ও মানুষের যোগদানের নিরিখে এ গ্রামে অন্তত মা দুর্গাকে হারিয়ে দিচ্ছে মেয়ে। শুধু একটাই প্রার্থনা বাসিন্দাদের, বৃষ্টি যেন না হয়। নাহলে বাজির লড়াই মাঠে মারা যাবে যে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন