কালনায় প্রথম বহুতল।
একসময় বর্ধমান রাজ পরিবারের হাওয়া বদলের জায়গা ছিল এ শহর। ক্রমে ভাগীরথী বেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, আশপাশ থেকে লোকের আনাগোনায় জনপদ গড়ে উঠল। রাজপরিবারের হাত ধরে গড়ে উঠল বেশ কিছু নজরকাড়া স্থাপত্য। জনবসতি বাড়ল। আড়েবহরে বাড়তে লাগল কালনা শহরও।
আশপাশের গ্রাম, মফস্সল থেকে এ শহরে আসার প্রবণতা সেই শুরু। দু’দশত আগেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, শহুরে সুযোগ-সুবিধার আকর্ষণে আশপাশের গ্রাম থেকে বহু মধ্যবিত্ত পরিবার উঠে আসে। এখনও স্কুল-কলেজ-সহ নানা দৈনন্দিন প্রয়োজনে নতুন নতুন মানুষ এসে ঘাঁটি গাড়ছেন এ শহরে।কিন্তু জনসংখ্যা বাড়লেও কালনার জমির ভাঁড়ার তো আর বাড়েনি। ফলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে নয়, এখন উপরে বাড়ছে শহর।
শহরের ১৮টি ওয়ার্ডে লোকসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। বছর দু’য়েক আগেও যেখানে কাঠা প্রতি তিন সাড়ে তিন লক্ষ টাকায় জমি মিলত এখন তা পাঁচের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। তাও চাহিদার তুলনায় ফাঁকা জমির পরিমাণ কম। খুঁজে-পেতে যদিও জমি মেলে সেখানে অনেকক্ষেত্রে চুন, বালি, সিমেন্ট, পাথর রাখারই জায়গা থাকে না। অতএব ভরসা ভাড়া বাড়ি। তার জন্যেও অবশ্য ভালই মূল্য চোকাতে হয়। শহরের চৌহদ্দির মধ্যে এক কামরার বাড়িভাড়া শুরু হাজার চারেক টাকায়। আর তার থেকে বড় বাড়ি হলে ভাড়া পৌঁছয় ৬-৮ হাজারেও। ভিন জেলা থেকে আসা শিক্ষক-শিক্ষিকা, চাকুরিজীবী, বা ব্যবসায়ী সকলেই দ্রুত ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের স্থায়ী আস্তানা খোঁজেন। কেউ কেউ আবার পুরনো বাড়িরও খোঁজ করেন।
শহরের বৈদ্যপুর মোড়ের ব্যবসায়ী বিকাশ ঘোষ বলেন, “তিন বছর ধরে একটা ছোট জমি খুঁজছি। যাতে দুটি ঘর আর রান্নাঘরটা অন্তত গড়া যায়। প্রথমত ভাল জায়গায় জমি পেলাম না। তার উপর বাড়ি তৈরির করতে খরচ পড়ছিল প্রায় ২২ লক্ষ টাকা। বাধ্য হয়ে ১৪ লক্ষ টাকা দিয়ে ছোট পুরনো বাড়ি কিনতে হল।” বছর চারেক আগে গ্রাম থেকে পাকাপাকি ভাবে শহরে চলে আসেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিমল মণ্ডল। ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুলে পড়ানোর জন্যই তার এমন সিদ্ধান্ত। পরিমলবাবুও জানান, জমির যা দাম তাতে পুরনো বাড়িই ভরসা। চড়া দাম আর ভিড়ে ঠাসা শহর থেকে নিষ্কৃতী পেতে অনেকেই আবার শহর লাগোয়া গ্রামগুলিতে জমি কিনছেন। সেখানেও জমির দান উর্ধ্বগামী।
ক্রমশ ঘিঞ্জি হচ্ছে চকবাজার এলাকা।
শহর জুড়ে জমির সমস্যা যে ক্রমশ বাড়ছে তা স্বীকার করেছেন কালনার পুরপ্রধান বিশ্বজিৎ কুণ্ডু। তিনি বলেন, “শহর লাগোয়া দুটি পঞ্চায়েতকে পুর এলাকার অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হবে।”
এরসঙ্গেই সম্প্রতি বহুতলও দেখছে এ শহর। শহরের পূর্ণ সিনেমা হল ভেঙে তৈরি হচ্ছে প্রথম বহুতল। একসময় পূর্ণ সিনেমা হলে নতুন সিনেমা এলেই ভিড় জমাতেন আশপাশের হাজারো গ্রামবাসী। তবে কেবল লাইন চলে আসায় এখন হলগুলি অনেকটাই নিষ্প্রভ। পূর্ণ সিনেমা হলও বিক্রি হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। ফ্ল্যাট তৈরি শুরুও হয়ে গিয়েছে। বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, ৫০ কাঠা জমিতে ৪টি রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। প্রতিটায় বিভিন্ন মাপের ৬৪টি করে ফ্ল্যাট থাকবে। কমপ্লেক্সের মধ্যে মিলবে নানা সুযোগ সুবিধাও। মালিকদের তরফে সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “সব ঠিকঠাক চললে ২০১৬-য় ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দেওয়া হবে ক্রেতাদের হাতে।” তাঁর দাবি, এত বড় কমপ্লেক্স গড়ার জন্য শহরে যথেষ্ট জায়গার অভাব। তাই সিনেমা হলের জমি কেনা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু কালনা তো এখনও ফ্ল্যাট কালচারে সেভাবে অভ্যস্ত নয়, সেখানে এই এত বড় কমপ্লেক্স কী ঝুঁকির হয়ে যাবে না? সুরজিৎবাবুর মত, শহরে জমির যা হাহাকার তাতে ফ্ল্যাট কেনার দিকে সাধারণ মানুষকে ঝুঁকতেই হবে। অনেকেই ফ্ল্যাট কেনায় আগ্রহী বলেও তাঁর দাবি।
কিন্তু ফ্ল্যাট কেনায় আগ্রহ থাকলেও শহরে যাঁদের পুরনো বড় বাড়ি রয়েছে, বা ফাঁকা জমি রয়েছে তাঁরা কি ফ্ল্যাটের জন্য জমি দিতে ইচ্ছুক? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অবশ্য একাধিক মত পাওয়া গিয়েছে। বাইরে থেকে এসে এ শহরে ঘাঁটি গেড়েছেন এমন অনেকেরই মত, কিছু জায়গায় জমির দাম ৯ লক্ষ টাকা কাঠাও ছুঁয়েছে। সাধারণ চাকুরীজীবীর পক্ষে সেই জমি কিনে বাড়ি করা কার্যত অসম্ভব। তার থেকে ১৫-১৮ লক্ষ টাকায় ফ্ল্যাট পাওয়া গেলে মন্দ কি? শহরেরই সরকারি চাকুরে এক যুবক জানান, ৮ কাঠা জমির উপর পুরনো বাড়ি রয়েছে তাঁদের। কয়েক ঘর ভাড়াটিয়াও রয়েছে। ভাড়াটেদের সঙ্গে প্রায়ই ঝামেলাও লাগে। তাঁর দাবি, কোনও সংস্থা রাজি হলে এবং ভাল দাম পেলে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট গড়ার অনুমতি দেওয়াই যায়। আর এক বাসিন্দা ভূপেন সরকারের মতে আবার, বাড়ির উঠোন থেকে বারান্দা সর্বত্রই নানা বয়সের নানা স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। তাই প্রোমোটারের হাতে বাড়ি তুলে দিতে নারাজ তিনি। অনেকের আবার ধারণা, বড় শিল্প না থাকায় এ শহরে এখনও ফ্ল্যাট সেভাবে মাথাচাড়া দেয়নি। শিল্প এলেই বাইরে থেকে আরও লোক আসবে, লেনদেন বাড়বে, তৈরি হবে বহুতলের চাহিদাও।
বহুতলের প্রয়োজনীয়তার কথা মেনে নিয়েছেন কালনার চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ কুণ্ডু। তিনি বলেন, “পুরসভা তিনতলা পর্যন্ত বাড়ির অনুমোদন দিতে পারে। বহুতলের ক্ষেত্রে জেলা থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন।” তবে বহুতল গড়তে ইচ্ছুক ব্যবসায়ীদের পাশে কালনা পুরসভা রয়েছে বলেও তাঁর আশ্বাস। মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষের মতে, সাধারণ বাড়ির থেকে ফ্ল্যাট অনেক বেশি নিরাপদ। কালনাতেও বহুতলের প্রয়োজন বাড়ছে বলে জানান তিনি।
ছবি: মধুমিতা মজুমদার।