দায়েমনগরের মণ্ডপ। শনিবার উদিত সিংহের তোলা ছবি।
এক সময়ে গ্রামে কোনও পুজো হতো না। আশ্বিনে দূরের গ্রাম থেকে যখন ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসত, মন খারাপ হয়ে যেত গ্রামবাসীদের। সেই দুঃখ দূর করতে বছর পঁচিশ আগে দুর্গাপুজোর আয়োজনের চেষ্টা করেছিলেন কয়েক জন বাসিন্দা। কিন্তু খরচের বহর দেখে পিছিয়ে আসতে হয়। তাঁদের সেই বিষন্নতা দূর করতে এগিয়ে আসেন প্রতিবেশী ওয়াজেদ আলিরা। এক সঙ্গে সকলের চেষ্টায় শুরু হয় লক্ষ্মীপুজো। আউশগ্রামের দায়েমনগরে সম্প্রীতির আবহেই চলে আসছে সেই পুজো।
স্থায়ী মণ্ডপের পাশেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ। মণ্ডপের সামনে রাস্তাও আলোয় সেজে উঠেছে। পুজোর কয়েক ঘণ্টা আগে শনিবার দুপুরে মণ্ডপের সামনে বসে শেষ মূ্হুর্তের আলোচনা সেরে নিচ্ছিলেন গ্রামবাসীরা। কারা এখনও চাঁদা দেয়নি, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন কত দূর, গ্রামের সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে কী ভাবে বিসর্জন করা হবে, সে সব নিয়েই আলোচনা মজেছিলেন জয়নাল শেখ, ওয়াজেদ আলি, পলাশ সামন্ত, সুভাষ সামন্ত, বেনো শেখরা। সকলেই এই ‘দায়েমনগর সর্বজনীন লক্ষ্মীপুজো’র সঙ্গে নানা ভাবে যুক্ত।
বর্ধমান শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে এই দায়েমনগরের বাসিন্দারা জানান, লক্ষ্মীপুজো তাঁদের গ্রামে সত্যিই মিলন উৎসবে পরিণত হয়েছে। উত্তরে গলসি আর দক্ষিণে আউশগ্রামের সন্নিহিত এই এলাকায় হাত ধরাধরি করে পুজো চালু করেছিলেন হিন্দু ও মুসলমান— উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। গ্রামবাসীরা জানালেন, ১৯৮১ সালে দুর্গাপুজো আয়োজন ফলপ্রসূ না হওয়ার পরে খেত পাহারা দিয়ে পাওয়া পারিশ্রমিকের ধান সামন্তপাড়ার বাসিন্দাদের হাতে তুলে দেন ওয়াজেদ আলিরা। সেই ধান বিক্রি করে লক্ষ্মী প্রতিমা আনা হয়। ওয়াজেদ বলেন, “আমরা সবাই রাতে খেত পাহারা দিতাম। গ্রামে দুর্গাপুজো আর্থিক কারণে হচ্ছে না শোনার পরে আমাদেরও মন ঠিক ছিল না। তখন সবাই মিলে ঠিক করি, পারিশ্রমিক বাবদ পাওয়া ধান লক্ষ্মী প্রতিমা আনতে কাজে লাগানো হোক।” এখন আর রাতপাহারা না থাকলেও চাঁদা দিতে কুণ্ঠা নেই সেলিম শেখ, জয়নাল আবেদিনদের। এ বার পুজোয় গ্রামকে ‘নির্মল’ করার জন্য প্রচার চালাচ্ছেন তাঁরা।
সামন্তপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা আনন্দ সামন্ত বলেন, “জয়নালদের সাহায্য ছাড়া পুজো করা সম্ভব হত না।” পুজো কমিটির সম্পাদক সুভাষ সামন্ত থেকে সাধারণ সদস্য বেনো শেখ, সকলেরই বক্তব্য, “আমরা সারা বছর এক সঙ্গে থাকি। এই পুজো বন্ধন আরও অটুট করে তোলে।” পুজো কমিটির সহ-সভাপতি জয়নাল শেখও বললেন, “সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বাড়ির মেয়েরাও যোগ দেয়। বিসর্জনের দিন সবাই মিলে নাচগান করি। দেখলেই বুঝবেন, আমরা কেমন আত্মীয়ের বন্ধনে রয়েছি।”
এই গ্রামের বাসিন্দা, কাঁকসা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মলয়কুমার সামন্ত বলেন, “পুজো তো নামেই। আসলে গ্রামের উৎসব, সেখানে সবার অবাধ বিচরণ।”