ডাকাতি হয়েছিল এই ভবনে। ছবি: বিকাশ মশান
গয়না ও মুদ্রা মিলিয়ে মোট প্রায় ৩৬ কেজি সোনা!
পুলিশের কাছে লুঠ হওয়া সামগ্রীর যে খতিয়ান জমা পড়েছিল, তাতে সংখ্যাটা ছিল এমনই। শহরের জনবহুল এলাকায় দিনের আলোয় সেই লুঠপাটের ঘটনায় রীতিমতো চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল শহরে। চোখ আরও কপালে উঠেছিল যখন লুঠ হওয়া সোনার বাজারমূল্য হিসেব করা হয়— প্রায় ১২ কোটি টাকা। সঙ্গে নগদ ১১ লক্ষ টাকাও লুঠ হয়েছিল বলে অভিযোগ। দেশের বড়সড় ডাকাতিগুলির তালিকায় এটি অন্যতম, জানায় পুলিশ।
২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দুর্গাপুরের ভিড়িঙ্গিতে বিকেল সওয়া ৩টে নাগাদ ঘটনাটি ঘটে। ভিড়িঙ্গি কালীবাড়ির কাছাকাছি নাচন রোডের ধারে তিন তলা বাড়ির উপরের তলায় বেসরকারি আর্থিক সংস্থার অফিসে ভিতরে তখন গ্রাহকদের ভিড়। সোনার গয়না বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে কেরালার ওই সংস্থায়। হঠাৎই আগ্নেয়াস্ত্র ও ভোজালি নিয়ে চড়াও হয় এক দল দুষ্কৃতী। মারধর করে একমাত্র রক্ষীর কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে তারা। মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়ে চাবি নিয়ে ভল্ট খোলে। তার পরে একটি ব্যাগে সোনার গয়না, মুদ্রা, নগদ টাকা ভরে চম্পট দেয়। সব মিলিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যে কাজ সারা। যাওয়ার আগে নিয়ে যায় সিসিটিভি-ও।
ঘটনার তদন্তে নামে কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ। সহযোগিতা করে সিআইডি। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে, দুষ্কৃতীদের এক জনের মুখ ঢাকা ছিল। এক জন বাংলায় কথা বলছিল। বাকিরা হিন্দিতে। বয়স বছর তিরিশের আশপাশে। ভারী গয়নাগুলি নিয়ে গেলেও তুলনায় হালকাগুলি রেখে যায় তারা। প্রায় ৭৫ কেজি সোনার গয়না ও মুদ্রা পাহারা দেওয়ার জন্য এক জন মাত্র নিরাপত্তারক্ষী কেন? বিপদঘণ্টি থাকা সত্বেও কেন কেউ তা বাজাননি? সংস্থার ভিতরের কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না, প্রশ্ন ওঠে তদন্তকারীদের মধ্যে।
তদন্তে জানা যায়, দুষ্কৃতীরা লুঠপাটের পরে ঝাড়খণ্ডের দিকে গিয়েছে। সূত্র ধরে পুলিশ পৌঁছয় মাওবাদী অধ্যুষিত বারোয়াড্ডায়। এই রকম এলাকায় অভিযান চালানোয় দক্ষ ঝাড়খণ্ডের প্রায় দেড়শো পুলিশকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ধানবাদের পুলিশ সুপার আর কে ধান, কমিশনারেটের তৎকালীন এডিসিপি (পূর্ব) সুনীল যাদব এবং তদন্তকারী অফিসার তীর্থেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে দশরথ মাহাতো নামে এক দুষ্কৃতীর বাড়িতে অভিযান চালান। দশরথ পালায়। তবে ধরা পড়ে তার স্ত্রী, শাশুড়ি ও দুই শ্যালক। তাদের গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ জানায়, বাড়ির উঠোনে কলসি থেকে পাওয়া যায় প্রায় ৪ কেজি সোনা। ঘরের ভিতরে মেলে ৪ লক্ষ ২২ হাজার ২২০ টাকা। এ ছাড়া ডাকাতির ঘটনার পরের দু’দিনে ধানবাদের রাজগঞ্জ বাজার থেকে কেনা তিনটি টিভি, একটি রেফ্রিজারেটর, দু’টি মিউজিক সিস্টেম, ছ’টি ফ্যান ও বেশ কিছু জামাকাপড় উদ্ধার হয়। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দশরথের পাশের বাড়ি থেকে ধরা হয় আর এক জনকে।
৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ধানবাদের সিন্ধ্রি থেকে আরও দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, দশরথ দীর্ঘদিন ধরে মোটরবাইক চুরিতে যুক্ত ছিল। ধানবাদ ও গয়ার সংশোধনাগারে থাকার সময়ে সে আরও কয়েক জন দুষ্কৃতীর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। বেরিয়ে এসে তারা একটি দল গড়ে। সেই দলটিই দুর্গাপুরের আর্থিক সংস্থায় হানা দেয় বলে তদন্তে জানা যায়, দাবি পুলিশের।
পরে ডাকাতির ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ওই দলের আরও সাত জনকে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ধরা পড়ে মোট ১৪ জন। আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। আদালত অবশ্য দশরথের শাশুড়ি, স্ত্রী ও গ্রেফতার হওয়া এক আইনজীবীকে জামিনে মুক্তি দেয়। বাকি ১১ জন রয়েছে জেলে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মামলার শুনানি প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। এ বার রায় ঘোষণার অপেক্ষা।
• ২০১৩-এর ১ ফেব্রুয়ারি বিকেল সওয়া ৩টে নাগাদ দুর্গাপুরের ভিড়িঙ্গি কালীবাড়ির কাছে নাচন রোডে বেসরকারি আর্থিক সংস্থায় লুঠ।
• আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে পনেরো মিনিট ধরে লুঠপাট চালায় দুষ্কৃতীরা।
• ঘটনায় জড়িতদের খোঁজে পুলিশের তল্লাশি ঝাড়খণ্ডে। উদ্ধার অনেক সোনা ও জিনিসপত্র। একে একে গ্রেফতার ১৪ জন।
• মামলার শুনানি প্রায় শেষ।