বার্নপুরে সাজছে রথ। —নিজস্ব চিত্র।
রাত পোহালেই রথযাত্রা। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রস্তুতি সারা শিল্পাঞ্চলেরও। কোথাও লোককথা, কোথাও বা শিল্পী নন্দলাল বসুর মুগ্ধ হওয়ার গল্প— রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে এমনই বিভিন্ন উপাদান।
দামোদরের পাড়ে হিরাপুরের মাণিকেশ্বর ধাম। ইতিহাসবিদেরা জানান, বহু দিন আগে রজনীকান্ত ব্রহ্মচারীকে আশ্রম বানানোর জন্য খানিকটা জমি দান করেন কাশীপুরের রাজা। তারপরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে রজনীকান্ত প্রবর্তন করেন রথযাত্রার। তৈরি হয় পিতলের রথ। তবে এখন লোহার রথেই উৎসব হয় বলে জানান রজনীকান্তের উত্তরসূরী পূর্ণিমা চক্রবর্তী। সীতারামপুরের রায়বাড়ির রথ প্রায় ১৮০ বছরের পুরনো। জমিদার বেণীমাধব রায়ের উদ্যোগে শুরু হয় রথযাত্রার। কুলটির উৎকল সমাজের রথের বয়স প্রায় ৮০ বছর। শোনা যায়, এই রথে পুজো করে গিয়েছেন পুরীর শঙ্করাচার্যও। কুলটির বেলরুইয়ের রায়বাড়ির রথ প্রায় দু’শতাব্দী পুরনো। অতীতে রথের দু’দিন ধানবাদ–সীতারামপুর ও অন্ডাল–সীতারামপুর লাইনে বিশেষ ট্রেন চলত। জমিদার পরিবারের প্রবীণ সদস্য নির্মল সিংহরায় জানান, রথে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামের জায়গায় তাঁদের কুলদেবতা লক্ষ্মী-জর্নাদনের মূর্তি বসানো হয়।
প্রতি বছরই সর্বজনীন রথ উৎসব পালন করে আসানসোলের গৌর মন্দির। গৌরমন্দির থেকে আসানসোল গ্রামের রামসায়র মাঠ পর্যন্ত রথের দড়ি টানতে ভিড় জমান কয়েক হাজার ভক্ত। রামসায়র মাঠে বসে রথের মেলাও। ইস্কনের রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় আসানসোলের বুধা মাঠে। সীতারামবাবার উদ্যোগে প্রায় ৬১ বছর আগে শুরু হয় বরাকরের সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের রথ উৎসব। তবে এখন অবশ্য রাস্তা খারাপ ও ঘিঞ্জি হওয়ায় রথ আর বের করা হয় না। ১৯৭৮ সালে ইস্কো কর্তৃপক্ষের সাহায্যে উৎকল সাংস্কৃতিক পরিষদ বার্নপুরের জগন্নাথ মন্দিরের রথ উৎসবের শুরু করে।
রথ উপলক্ষে চিত্তরঞ্জনে ভিড় জমান পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের বহু মানুষও। এখানের ছয়ের পল্লির রথ উৎসব এ বার ৬১ বছরে পড়ল। ফতেপুর এলাকায় পুরীর মন্দিরের আদলে তৈরি স্থায়ী মন্দিরের রথ দেখতেও মানুষের ভিড় হয় নজরকাড়া।
শিল্পাঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন রথ উৎসবটি হয় রানিগঞ্জের সিহারশোলে। দেড়শো বছরের এই রথযাত্রা শুরু হয় জমিদার গোবিন্দ প্রসাদের উদ্যোগে। এখন রথযাত্রা উপলক্ষে মেলার দায়িত্বে রয়েছে সিহারশোল স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন। জমিদারবাড়ির মেয়ে অনুরাধা মালিয়া জানান, তাঁদের রথে রয়েছেন কুলদেবতা দামোদরচন্দ্রকে। ১৬৯ বছরে পা দিয়েছে অন্ডালের উখড়ার জমিদার বাড়ির রথযাত্রাও।
রথযাত্রা উপলক্ষে কাঁকসা, মানকর প্রভৃতি এলাকাতেও বহু ঘটনার কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এখানের অন্যতম প্রাচীন রথটি রয়েছে কাঁকসার বনকাটিতে। জমিদার রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রায় দু’শতাব্দী আগে শুরু হয় এখানের রথযাত্রা। জনশ্রুতিতে বলা হয়, ওড়িশা থেকে শিল্পীরা এসে এই পিতলের রথটি তৈরি করেন। রথের শিল্পকার্য মুগ্ধ করেছিল আচার্য নন্দলাল বসুকেও। পরেশচন্দ্র দত্তের রাঢ় এলাকার পুরাতত্ত্ব গবেষণাতেও রয়েছে এই তথ্য। কেন্দ্রীয় সরকার এই রথটি সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছে বলে জানান অযোধ্যা গ্রামের বাসিন্দা রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। মানকরের কর বাড়ির রথের বয়সও এক শতাব্দী পেরিয়েছে। দক্ষিণ রাইপুরের গোস্বামী পাড়ার লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির থেকে রথযাত্রা শুরু হয়ে মানকর হাসপাতালের সামনের মাঠে গিয়ে তা শেষ হয়।
রথযাত্রা উপলক্ষে মেলা আর উৎসবে মাততে তৈরি শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মের মানুষও।