সাহস করে বিয়েতে না মেয়েদের

ওড়িশি নাচে পারদর্শী নেহাতি তিওয়ারির (নাম পরিবর্তিত) বিয়ে ঠিক করেছিলেন অভিভাবকরা। বর্ধমানের নেহরু বিদ্যামন্দিরের একাদশ শ্রেণির ওই ছাত্রী সরাসরি চাইল্ডলাইনের বর্ধমানের অফিসে যোগাযোগ করে। সপ্তাহখানেক আগে চাইল্ডলাইন গিয়ে ছাত্রীর পরিজনদের বুঝিয়ে বিয়ে থেকে নিরস্ত করে।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৭ ০১:০৩
Share:

ওড়িশি নাচে পারদর্শী নেহাতি তিওয়ারির (নাম পরিবর্তিত) বিয়ে ঠিক করেছিলেন অভিভাবকরা। বর্ধমানের নেহরু বিদ্যামন্দিরের একাদশ শ্রেণির ওই ছাত্রী সরাসরি চাইল্ডলাইনের বর্ধমানের অফিসে যোগাযোগ করে। সপ্তাহখানেক আগে চাইল্ডলাইন গিয়ে ছাত্রীর পরিজনদের বুঝিয়ে বিয়ে থেকে নিরস্ত করে।

Advertisement

দশম শ্রেণিতে উঠতেই বর্ধমানের জ্যোতরাম গার্লস উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী মোহিনী মল্লিকের (নাম পরিবর্তিত) বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বিয়ে না করে পড়তে চাওয়া, এবং বিয়েতে আপত্তির কথা সে জানায় বাড়িতে। অভিভাবকরা কান দেননি। শেষ পর্যন্ত সাহস করে ‘১০৯৮’-এ ফোন করে চাইল্ডলাইনে যোগাযোগ করে নিজের বিয়ে আটকায় সে।

শুধু ওই দুটি ঘটনা নয়, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে চাইল্ডলাইন কিংবা প্রশাসনের কাছে নাবালিকার বিয়ের যত খবর এসেছে, তার বেশির ভাগই ‘কনে’রা দিয়েছে। তাতেই বড় একটা সামাজিক বদল দেখছেন অনেকেই। চাইল্ডলাইনের বর্ধমানের কো-অর্ডিনেটর অভিষেক বিশ্বাস বলছেন, “আগেও নাবালিকারা জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানাত। কিন্তু বাড়িতে ভয়ে চুপ করে থাকত। তাতে আমাদের কাজটা কঠিন হত। গত কয়েক মাস ধরে দেখছি, আমাদের সামনেই পরিজনদের কাছে বিয়েতে না বলার সাহস দেখাচ্ছে অনেকে।”

Advertisement

প্রশাসনেরই হিসেব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৪টির মধ্যে ১০টি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫টির মধ্যে ১০টি ক্ষেত্রে নাবালিকারাই সাহসে ভর করে খবর দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে চাইল্ডলাইন ও শিশুকল্যাণ কমিটির কর্তারা মেমারির দুটি ঘটনা সামনে তুলে আনছেন।

গত বছর মেমারির কালীবেলের কাছে একটি গ্রামের নাবালিকার বিয়ে দিচ্ছিল পরিজনেরা। গন্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী চাইল্ডলাইনে যোগাযোগ করে। চাইল্ডলাইনের দু’জন কর্মী গ্রামে যেতেই পরিজনেরা রে রে করে তেড়ে আসেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসে ছাত্রীটিই। সে সকলের সামনে বলে, ‘এখন বিয়ে নয়, পড়তে চাই। সে কথা কেউ শুনছে না বলেই তো আমি দিদিদের ফোন করেছিলাম’। সাহস করে মনের কথাটা বলে ফেলায় বাড়ির লোকেরা পিছিয়ে যান। আর অঞ্জলি মাড্ডি তো মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে চলে এসে শিশুকল্যাণ কমিটির (সিডব্লুসি) হোমে চলে এসেছিল। সেখান থেকেই সে পুলিশি পাহারায় মাধ্যমিক দেয়। জেলা শিশুকল্যাণ কমিটির সভাপতি দেবাশিস নাগ বলেন, “বাড়ির সবাইকে ছেড়ে একটি মেয়ে হোমে থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল, এটাই তো বিরল ঘটনা।’’ মেমারির অঞ্জলি মাড্ডিকে ‘বিয়ে নয়, পড়তে চাই’ স্লোগানের মডেল করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন দেবাশিসবাবু।

অভিভাবকদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস মিলছে কী ভাবে?

চাইল্ডলাইনের কাউন্সেলিং বিভাগের কর্ত্রী মহুয়া গুঁই এর মধ্যে সামাজিক সচেতনতা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, লড়াইয়ের ইচ্ছে দেখছেন। তাঁর কথায়, “আমাদের কাছে অনেকেই জানিয়েছে, বিয়ে মানেই পরাধীন। অল্প বয়সই তারা আর পরাধীন থাকতে চাইছে না। তাই মনের কথাটা বলার সাহস পাচ্ছে। প্রয়োজনে অভিভাবকদের বিরুদ্ধে যেতেও পিছপা হচ্ছে না।’’ এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত, মনোবিদ সপ্তর্ষি অধিকারীও। তিনি যোগ করছেন, “গ্রামে গিয়ে দেখেছি, মেয়েদের স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছে তীব্র হচ্ছে। সেখান থেকেই বিয়েতে না বলার সাহস তৈরি হচ্ছে।”

নতুন এই প্রবণতায় রাজ্য সরকারের বড় ভূমিকা দেখতে পারছেন বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। তাঁর দাবি, “রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প মেয়েদেরকে পড়ার সুযোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কর্মসংস্থানেরও নানা প্রকল্পের কথা জানতে পারছে মেয়েরা। সে জন্যই সাহসী হয়ে উঠছে। ওদের পাশে আমরা আছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন