শহর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বহুতল। ছবি: বিকাশ মশান।
শহরের অবয়ব বাড়ছে দিন দিন। নতুন নতুন বহুতল। শপিং মল, ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে নানাবিধ কলেজ। কিন্তু শহর যে সব দিকে বেড়েছে, তার অনেক জায়গাতেই মেলে না নাগরিক পরিষেবা। কারণ, বারবার দাবি জানানো হলেও পুরসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এই সব এলাকাকে। পানীয় জল থেকে রাস্তার আলো, সব কিছু নিয়েই সমস্যায় ভোগেন সেখানকার বাসিন্দারা। তাই শহরে থেকেও যেন শহরবাসীর স্বীকৃতি নেই, মনে করেন দুর্গাপুরের গোপালপুর বা জেমুয়ার মানুষজন।
আয়তন এবং জনসংখ্যা— দু’দিক থেকেই রাজ্যে কলকাতার পরে দ্বিতীয় বড় শহর দুর্গাপুর। ৪৩টি ওয়ার্ডের এই শহর নোটিফায়েড এরিয়া থেকে পুরসভার স্বীকৃতি পায় ১৯৯৭ সালে। নয়ের দশক থেকে এখানে নানা কল-কারখানা তৈরির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স, বড় হোটেল, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার শো-রুম। তৈরি হয় বহু স্কুল, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট কলেজ। চালু হয় তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক। বাইরের মানুষের ভিড় বাড়ে শহরে। মাথা তোলে নতুন নতুন বহুতল। সেগুলির বেশির ভাগই পুর এলাকার বাইরে।
নির্মাতারা জানান, পুরসভা এলাকায় জমির দাম বেশি। বহুতল নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া সময় ও খরচসাপেক্ষ। তুলনায় পঞ্চায়েত এলাকায় সহজে অনুমোদন মেলে। নির্মাণের খরচও শহরের তুলনায় কম। ফলে, প্রকল্প থেকে মুনাফা লাভের সুযোগ বেশি। গত কয়েক বছরে পুরসভা লাগোয়া পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতে প্রচুর বহুতল গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেখানে ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা পান না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। তাঁরা জানান, রাস্তাঘাট বেহাল। রাস্তায় আলো নেই। প্রকল্প এলাকার বাইরে পাকা নিকাশি ব্যবস্থার প্রায় বালাই নেই। নেই জল সরবরাহের ব্যবস্থা। সাবমার্সিবল পাম্পের সাহায্যে জল তুলে সরবরাহ করা হয়। বর্জ্য ফেলা হয় পাশের ফাঁকা মাঠ বা পুকুরে। ফলে, এলাকায় দূষণ ছড়ায়।
দুর্গাপুরের মুচিপাড়া পেরোলেই বামুনাড়া। তা কাঁকসা ব্লকের অন্তর্গত। সেখানে বহু আবাসনে মানুষজন রয়েছেন। আরও বেশ কয়েকটি আবাসন তৈরি হচ্ছে। কাঁকসা পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে একটি শপিংমলও গড়ে উঠেছে। তবে তা এখনও চালু হয়নি। পঞ্চায়েত সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম দরপত্রে আশানুরূপ সাড়া না মেলায় ফের তা ডাকা হয়েছে। মুচিপাড়ার কাছে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে একটি বড় সংস্থা আবাসন প্রকল্প গড়ছে। সেখানে একটি বড় হোটেল গড়ারও কাজ চলছে। বামুনাড়া ছাড়িয়ে গোপালপুর থেকে আড়রা— সর্বত্র গড়ে উঠেছে বহুতল। তৈরি হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট কলেজ, বিএড কলেজ, এমএড কলেজ, ব্যাঙ্ক।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল রোডের এক দিকটি পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ড, অন্য দিক আবার জেমুয়া পঞ্চায়েতের অধীনে। কালীগঞ্জ, শঙ্করপুর, টেটিখোলা, সপ্তর্ষি পার্ক, গোল্ডেন পার্ক, ইন্দো-আমেরিকান পার্কের মতো এলাকাগুলির সঙ্গে শহরাঞ্চলের কার্যত কোনও ফারাক নেই। তফাত শুধু পরিষেবায়। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের একেবারে গা ঘেঁষে রয়েছে আর্যভট্ট পার্ক, সেক্টর ১, সেক্টর ২, বিধান পার্কের মতো এলাকা। দেখে বোঝার উপায় নেই, সেগুলি পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। এমনকী, একই মৌজার একাংশ পড়ছে পুরসভা এলাকায়। অন্য অংশ রয়েছে পঞ্চায়েতে।
ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাস এবং এলাকা অর্ন্তভুক্তি নিয়ে উদ্যোগ যে একেবারে হয়নি, তা নয়। তবে শেষ পর্যন্ত কার্যকর কবে হবে সে নিয়ে সংশয় রয়েছে। ২০০৮ সালে ওয়ার্ড সংখ্যা ৪৩ থেকে ৫০ করার জন্য বিধানসভা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন আনা হয়। কিন্তু সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১২ সালে বামেদের সরিয়ে পুরসভায় ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড ওয়ার্ড পুনর্বিন্যাসের জন্য কমিটি গড়েছে। প্রাথমিক রিপোর্টও জমা পড়েছে। তবে পুরকর্তারা এ নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ।
তৃণমূল পুরসভায় ক্ষমতায় আসার পরপরই শহরের বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্জ্য কোথায় ফেলা হবে তার কোনও সুষ্ঠু সমাধান এখনও হয়নি। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে হাত দেওয়া হয়েছিল ১৫ এমজিডি ক্ষমতাসম্পন্ন জলপ্রকল্পে। তা প্রায় শেষের মুখে। কিন্তু এখান থেকে জল যাবে আইকিউ সিটিতে, অন্ডাল বিমাননগরীতে। তা ছাড়া শহরের বহু জায়গাতেই পানীয় জলের চাহিদা মেটে না। এমন পরিস্থিতিতে শহরের গা ঘেঁষে তৈরি বহুতলগুলি আদৌ সেখান থেকে জল পাবে কি না, সে নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কার্যত শহরে থেকেও তাই সুযোগ-সুবিধা নেই, আফশোস বহুতলগুলির বাসিন্দাদের। (চলবে)