এই বাড়িতেই খুন হন দিলীপবাবু। —নিজস্ব চিত্র।
•দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারে ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাড়িতেই খুন হন বছর আশির দিলীপকুমার বসু।
• লুঠ করতে এসে মাথার পিছন দিকে আঘাত করে খুন করে দুষ্কৃতীরা, তদন্তে জেনেছিল পুলিশ।
•তিন অভিযুক্তের দু’জন পরে ধরা পড়ে। তারা এখন জামিনে মুক্ত।
• মামলার শুনানি এখনও শুরু হয়নি দুর্গাপুর আদালতে।
একতলা বাড়িটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে এখনও অনেকে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান। এক পলক দেখেন বাড়িটার দিকে। জমজমাট এলাকায় ভরসন্ধ্যায় এই বাড়িতেই খুন হয়েছিলেন বৃদ্ধ গৃহকর্তা, যেন বিশ্বাসই হয় না তাঁদের।
দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারে উদয়শঙ্কর বীথির ৪১ নম্বর ওই বাড়িতে থাকতেন দিলীপকুমার বসু। সঙ্গে ছোট মেয়ে, এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী সোনালি বসু। দিলীপবাবুর বড় মেয়ে শম্পা বসু তখন আসানসোল মহিলা থানার ওসি। ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাড়িতে একাই ছিলেন দিলীপবাবু। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের অ্যাকাউন্টস বিভাগের প্রাক্তন কর্মী দিলীপবাবু শারীরিক সমস্যার কারণে বিশেষ বাইরে বেরোতেন না। সেই সন্ধ্যায় তাঁর ছোট মেয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন, বাইরের ঘরে রক্তাক্ত অবস্থা পড়ে রয়েছেন বাবা। মাথার পিছনের দিকে আঘাতের চিহ্ন।
চিৎকার-চেঁচামেচি করে আশপাশের লোকজনকে খবর দেন সোনালি। ফোন করেন দিদিকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় দিলীপবাবুর। ঘটনাস্থলে তদন্তে আসেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ নিজে। কুকুর নিয়ে এসে তল্লাশি চালিয়েও কোনও সূত্র পায়নি পুলিশ। রাস্তার পাশে বাড়ি। উল্টো দিকের মাঠে রাত পর্যন্ত খেলাধুলো করতেন এলাকার অনেকে। সান্ধ্যভ্রমণে বেরোতেন পাড়ার প্রবীণেরা। এমন একটি এলাকায় সন্ধেবেলায় খুনের ঘটনায় আতঙ্ক তৈরি হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাড়ি থেকে টাকা ও গয়না উধাও হওয়ায় বোঝা যায়, লুঠপাটে এসেই দুষ্কৃতীরা খুন করে বৃদ্ধকে। আলমারির তালা ভাঙা হয়নি। চাবি দিয়ে আলমারি খোলা হয়েছে। তা দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়, দুষ্কৃতীদের কারও এই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল। সে জানত, আলমারির চাবি কোথায় থাকে। দিলীপবাবু তাকে চিনতে পারায় তাঁকে খুন করা হয় বলে অনুমান করেছিল পুলিশ। কিন্তু কী ভাবে ভরসন্ধ্যায় অনায়াসে এমন দুষ্কর্ম করে পালিয়ে গেল আততায়ীরা, সে ধন্দ কাটেনি তদন্তকারীদের। কয়েক মাস পরেও দুষ্কৃতীদের কোনও হদিস না পেয়ে তদন্তভার সিআইডি-কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ কমিশনারেট।
বছরখানেক পরে অবশ্য পুলিশ কমিশনারেটই পাকড়াও করে ফেলে এক অভিযুক্তকে। তবে তা এক ঘটনাচক্রে। সিটি সেন্টারের একটি চুরির মামলার তদন্ত করছিল পুলিশ। সেই সূত্রে পুলিশ মুর্শিদাবাদের লালবাগের শেখ লালবাবু নামে এক জনের খোঁজ পায়। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি তাকে ধরে আনা হয় দুর্গাপুরে। পুলিশের দাবি, জেরা করার সময়ে লালবাবু স্বীকার করে, আরও দুই সঙ্গীর সঙ্গে তারাই দিলীপবাবুকে খুন করেছিল। বহু বছর ধরে সে সিটি সেন্টার এলাকায় মজুরের কাজ করত। কাজের জন্য ওই বাড়িতে আগে গিয়েছে। রড দিয়ে দিলীপবাবুর মাথার পিছনে আঘাত করা হয়েছিল বলে জেরায় জানতে পারে পুলিশ। ধৃতকে নিয়ে গিয়ে লালবাগ থেকে সেই রডটি উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার হয় চুরি যাওয়া কিছু গয়নাও। মাসখানেক পরে লালবাবুর এক সঙ্গীকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। আর এক জন অধরাই। দু’জনকে গ্রেফতার করার পরে পুলিশ আদালতে মামলার চার্জশিট পেশ করে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৫-র পুজোর আগে ধৃত দু’জন জামিনে ছাড়া পেয়েছে। তবে মামলার শুনানি এখনও শুরু হয়নি দুর্গাপুরে আদালতে। দিলীপবাবুর মেয়ে শম্পা বলেন, ‘‘মামলা এখনও আদালতে ওঠেনি। বাবাকে যারা খুন করল, তাদের সাজা চাই।’’
চার বছর পরেও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। অভিযুক্তদের মধ্যে এক জন অধরাই রয়ে গিয়েছে। দু’জন জামিনে মুক্ত। শহরের এমন জায়গায় এই ধরনের ঘটনায় তখন রীতিমতো চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল। ওই বাড়ির দিকে চেয়ে সেই স্মৃতি ফিরে আসায় এখনও আতঙ্কে ভোগেন সিটি সেন্টারের উদয়শঙ্কর বীথির বাসিন্দারা।