গতির নেশায় লাগাম চাই, দাবি শহরে

ঝাঁ চকচকে রাস্তায় নানা গাড়ির ফাঁক গলে সাঁ করে তাঁদের বেরিয়ে যেতে দেখা যায় হামেশাই। ডান-দিক বাঁ দিকে কাটিয়ে, এ গাড়ি, ও গাড়ি টপকে  টপকে সুড়ুৎ করে চলে যাওয়া তাঁদের কাছে যেন জলভাত। রাস্তা যত ভাল, গতি ততই বেশি।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৫৫
Share:

জটলা: দুর্ঘটনায় মৃতের বাড়ির সামনে প্রতিবেশীরা। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেরিয়ে বাড়ির কাছে এসে দুই মৃত্যু, তুলে দিল অনেক প্রশ্ন।

Advertisement

ঝাঁ চকচকে রাস্তায় নানা গাড়ির ফাঁক গলে সাঁ করে তাঁদের বেরিয়ে যেতে দেখা যায় হামেশাই। ডান-দিক বাঁ দিকে কাটিয়ে, এ গাড়ি, ও গাড়ি টপকে টপকে সুড়ুৎ করে চলে যাওয়া তাঁদের কাছে যেন জলভাত। রাস্তা যত ভাল, গতি ততই বেশি। গতির ঝড় তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলেন মাঝে-মধ্যেই। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কখনও প্রাণ যায় নিজের, কখনও নিরীহ পথচারীর। জাতীয় সড়কে রেসে নামা এই মোটরবাইক চালকেরা কতটা নিয়ম মেনে চলেন, বর্ধমানের দুই কলেজ পড়ুয়ার মৃত্যুতে উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্নই।

২৪ ঘণ্টায় ১৬৬৪ কিলোমিটার পথ পেরোনোর ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে শুক্রবার ভোরে বেরিয়েছিলেন বর্ধমান শহরের বাসিন্দা বিক্রম হাজরা (২২) ও রিয়া চক্রবর্তী (২১)। প্রায় ১৬৫০ কিলোমিটার পার করেও ফেলেছিলেন। শনিবার ভোরে গলসিতে ২ নম্বর জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তাঁরা।

Advertisement

সপ্তাহ দুয়েক আগে এমনই রেস করতে বেরিয়ে শক্তিগড়ের কাছে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সল্টলেকের বাসিন্দা বরুণ কেজরিবালের (৩৫)। এই ধরনের বিপজ্জনক খেলা বন্ধের আর্জি জানিয়ে শহরের বাসিন্দারা স্মারকলিপি দিয়েছেন পুলিশকে।

কী ভাবে এই রেসে যুক্ত হয় মোটরবাইক চালকেরা, প্রশ্ন উঠেছে এই ঘটনার পরে। জানা গিয়েছে, বর্ধমান-কালনা-কাটোয়ার প্রায় ১৬০ জন যুবক দূরপাল্লার এমন রেস করেন। তাঁদের কয়েকজনের দাবি, অনলাইনে নানা রকম গতির খেলা রয়েছে। সেখানে যোগ দিলে ফোনে মেসেজ আসে। সেই ‘চ্যালেঞ্জ’ নেন অনেকে। কিছু মোটরবাইক সংস্থাও নির্দিষ্ট দূরত্বের রেস জিতলে শংসাপত্র দিয়ে থাকে। সেই লোভেও অনেকে নামেন। আবার নিজেরাই বাজি ধরে অনেক সময়ে রেস করেন। গোটা ব্যাপারটাই হয় অসংগঠিত ভাবে। কোথাও কোনও অনুমতি নেওয়ার বালাই থাকে না। শনি ও রবিবার জাতীয় সড়কে এই সব রেসের জন্য ভিড় বাড়ে।

বিক্রম-রিয়ার ক্ষেত্রে এ সবের কিছু ঘটেছিল কি না, সে নিয়ে ধন্দে পরিবারের লোকজন। পরিজনদের অভিযোগ, শহরের একটি মোটর স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের ইন্ধনেই উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরে গিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে ফেরত আসার চ্যালেঞ্জ নেন বিক্রম। রিয়ার এক আত্মীয়া আবার দাবি করেন, ‘‘যাওয়ার আগে ও বলে গিয়েছিল, এটা জিততে পারলে অনেক টাকা আর শংসাপত্র পাওয়া যাবে। তবে কারা দেবে, সেটা জানায়নি।’’ রিয়ার বাবা শিবনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিক্রম আমাকে জানিয়েছিল, ৮টা বাইকে ১৬ জন যাবে। প্রশাসন-পুলিশকে না জানিয়েই গিয়েছিল।’’ পরিজনদের একাংশের দাবি, বিক্রমের ব্যাগে মেলা একটি ডায়েরিতে নানা জায়গার নাম লিখে সময়ের উল্লেখ করা রয়েছে। সেখানে বর্ধমানের উল্লেখ রয়েছে ২.৩৫ মিনিটে। এ নিয়েও ধন্দে তাঁরা।

রিয়া বাইক চালাতে জানতেন না। অর্থাৎ, দীর্ঘ পথ টানা একাই বাইক চালিয়েছেন বিক্রম। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ডেপুটি সুপার অমিতাভ সাহা বলেন, ‘‘২৪ ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালানোয় ক্লান্তি গ্রাস করে। ভোরের দিকে চোখের পাতা বুজে আসে। তখন কোনও গাড়িই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। সে জন্যও দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।” পুলিশ জানায়, দু’জনের মাথাতেই হেলমেট ছিল। হাঁটু-কনুইয়ে ‘গার্ড’ও ছিল। জেলার পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, ‘‘শহরের ভিতর মোটরবাইক রেস বন্ধ করা গিয়েছে। জাতীয় সড়কেও নজর রাখছি।’’

বিবেকানন্দ কলেজ মোড়ে বিক্রমের বাড়ির সামনে রবিবারও পড়শিদের জটলা। তাঁরা জানান, বিক্রমের বাবা বিদ্যুৎবাবু ও মা মিতাদেবীকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হয়েছে। একমাত্র সন্তানের শোকে তাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ছেন। সম্পর্কে বিক্রমের দিদি শম্পা মল্লিক বলেন, ‘‘যাওয়ার আগে ওর মা বারণ করেছিলেন। কিন্তু শোনেনি।’’ পড়শিরা জানান, বিক্রম আগেও বাইক নিয়ে দূরদূরান্তে গিয়েছিলেন। রিয়ার বাবা শিবনাথবাবুর আক্ষেপ, ‘‘বিক্রমই হাত ধরে নিয়ে গেল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ফেরার কথা ছিল। আমার কথা তো শুনলই না! এ রকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে তা সকলের দেখা উচিত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন