বিক্রম হাজরা ও রিয়া চক্রবর্তী
লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ ঘণ্টায় ১৬৬৪ কিলোমিটার। আর প্রায় পনেরো কিলোমিটার পেরোলেই তা পূরণ হয়ে যেত। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মোটরবাইক রেসে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল বর্ধমানের যুবক-যুবতীর। শনিবার ভোরে গলসিতে ২ নম্বর জাতীয় সড়কে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তাঁদের উদ্ধার করে পুলিশ। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পথেই তাঁদের মৃত্যু হয়।
পুলিশ জানায়, বিক্রম হাজরা (২২) নামে ওই যুবক বর্ধমান শহরের বিবেকানন্দ কলেজ মোড় ও তাঁর বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তী (২১) বড়নীলপুরের বাসিন্দা ছিলেন। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমান থেকে মোটরবাইকে উত্তরপ্রদেশের ফতেপুর গিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে ফেরত আসার ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে শুক্রবার ভোরে বেরিয়েছিলেন দু’জনে। এ ব্যাপারে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে শনিবার শহরের এক মোটর স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের কর্ণধারের উপরে চড়াও হন মৃতদের কিছু পরিজন। শঙ্কর মুরারকা নামে ওই পরিজনকে উদ্ধার করে পুলিশ।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, রাজ কলেজের ইংরেজি অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বিক্রমের মোটরবাইক চালানোর নেশা ছিল। বিবেকানন্দ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রিয়াকে সঙ্গে নিয়ে মাঝে-মধ্যেই বেরিয়ে পড়তেন তিনি। রিয়া অবশ্য মোটরবাইক চালাতে পারতেন না। ফতেপুর রওনা হওয়ার আগে বিক্রম ফেসবুকে পোস্ট করেন, ‘গতি যদি আমাকে খুন করে, তাহলে কেউ কান্নাকাটি করো না’। এ দিন সকালে জাতীয় সড়কে কোনও গাড়ি তাদের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায় বলে পুলিশের অনুমান।
শোকস্তব্ধ: দুঃসংবাদ পাওয়ার পরে বর্ধমান মেডিক্যালে দুই ছাত্রছাত্রীর পরিজনেরা।
একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে বারবার অচেতন হয়ে পড়ছেন বিক্রমের বাবা, রায়নার দলুইদিঘি স্কুলের শিক্ষক বিদ্যুৎবাবু ও মা মিতাদেবী। বিক্রমের কাকা তড়িৎবাবু বলেন, ‘‘মোটরবাইকের রেস করা নেশা হয়ে উঠেছিল। তার টানেই প্রাণ গেল।’’ একই পরিস্থিতি রিয়ার বাড়িতেও। বছর দু’য়েক আগে রিয়ার দাদারও দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে থাকতেন একটি হোটেলের কর্মী শিবনাথ চক্রবর্তী। তাঁদের আত্মীয় সাহেব ঘোষ, সুব্রত ভক্তদের কথায়, ‘‘ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। মাঝে-মধ্যেই মোটরবাইকে বেড়াতে যেত। কিন্তু এ রকম ঘটবে, কল্পনারও বাইরে!’’
পরিবারের অভিযোগ, শঙ্করই বাইক-রেস করতে উৎসাহ দেন বিক্রমকে। তারই জেরে দু’জনের মৃত্যু হল। এ দিন শঙ্কর হাসপাতালে এলে তাঁর উপরে চড়াও হন মৃতদের কয়েকজন প্রতিবেশী-পরিজন। রাকেশ দাঁ, অঙ্কন দাস, আশিস সরকারদের ক্ষোভ, ‘‘শঙ্কর নিজের উদাহরণ দিয়ে সংস্থার সদস্যদের উৎসাহিত করেন। মোটরবাইক রেসে উৎসাহ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। প্রশাসনের পদক্ষেপ করা উচিত।’’ যদিও শঙ্করের বক্তব্য, ‘‘আমি প্রায় ২৩ ঘণ্টায় ওই পথ যাতায়াত করেছি। তা জানার পরে আমাকে না জানিয়েই বিক্রম চলে গিয়েছিল। জানতে পেরে বারণ করলেও কথা শোনেনি।’’
শঙ্করের বিরুদ্ধে অবশ্য কেউ কোনও লিখিত অভিযোগ করেননি। পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, ‘‘কী ঘটেছে খতিয়ে দেখা হবে।’’ জেলার এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘বেপরোয়া ভাবে গাড়ি, মোটরবাইক চালানো আটকাতে জেলায় এক বছরে ৫৮৯টি সচেতনতা প্রচার করা হয়েছে। তার পরেও অনেকে সতর্ক হচ্ছেন না, যা দুর্ভাগ্যজনক।’’
—নিজস্ব চিত্র।