কেব্লস কারখানার স্কুলের ছাত্রীদের মুখের হাসি উধাও। ছবি: পাপন চৌধুরী
সরকারের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগানের কী হবে! কাঁদতে কাঁদতে বার বার এই প্রশ্নটাই শিক্ষা আধিকারিককে বলছিল রূপনারায়ণপুর কেব্লস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী অঙ্কিতা বর্মন। তার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারেননি কারখানার শিক্ষা দফতরের আধিকারিক উমেশ ঝা।
অঙ্কিতার মতো প্রায় ২৫৪ জন পড়ুয়ার কাছে শুক্রবারই শেষ দিন ছিল রূপনারায়ণপুরের কেব্লস স্কুলের দরজা। এ দিন সকাল থেকেই স্কুলের অফিস ঘরে তারা টিসি নেওয়ার জন্য ভিড় জমিয়েছিল। গত বছরের ঠিক এই সময়ই কেব্লস কারখানার প্রশাসনিক ভবনে শ্রমিক-কর্মীরা ভিড় জমিয়েছিলেন স্বেচ্ছাবসরের কাগজ নেওয়ার জন্য। ওই দিনও ঠিক একই ভাবে মাঝপথে চাকরি চলে যাওয়ার দুঃখে অনেকেই কেঁদে উঠেছিলেন। বছর ঘুরতেই সেই চোখের জল দেখল রূপনারায়ণপুর।
কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে এক বছর আগে। তাই কারখানার অধীনে থাকা দু’টি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলেও শেষ পর্যন্ত তালাই ঝুলিয়ে দিলেন কর্তৃপক্ষ। তবে পড়ুয়াদের কথা ভেবে গত এক বছর ধরে স্কুল খুলে রাখা হয়েছিল। স্কুল ভবনের দেখভাল থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের বেতনও দিয়েছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। পড়ুয়াদের পড়াশোনা যেন মাঝপথে বন্ধ না হয় তা সুনিশ্চিত করতে তাদের অন্য স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেছে রাজ্য শিক্ষা দফতর। জেলা শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে চিত্তরঞ্জনের কস্তুরবা গাঁধী, এমএস বালিকা বিদ্যালয়, রূপনারায়ণপুরের আছড়া যজ্ঞেশ্বর ও পঞ্চমপল্লি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে এই পড়ুয়াদের ভর্তি নেওয়ার নির্দেশ পাঠানো হয়েছে।
এ দিন স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, পড়ুয়ারা স্কুলের পোশাক পরেই স্কুলে এসেছে। কিন্তু কারও মুখে হাসি নেই। কারণ, প্রত্যেকেই জানে এ দিনই এখানে তাদের শেষ দিন। সোমবার থেকে তাদের ঠিকানা নতুন স্কুল। কিন্তু এ নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। কথা বলার সময় নবম শ্রেণির সোনালি মিশ্র বলে, ‘‘নতুন স্কুল বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তাই সেখানে পড়তে যাওয়া নাও হতে পারে। হয়তো মাঝ পথেই পড়া বন্ধ হয়ে যাবে!’’ একাদশ শ্রেণির ছাত্র পীযূষ সেনের কথায়, ‘‘আমাকে আসানসোলের জহরমল স্কুলে ভর্তি হতে বলা হয়েছে। আমার পক্ষে অসম্ভব। বুঝতে পারছি না কী করব।’’
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকেরাও। এ দিন সকালেই ছেলেমেয়েদের হাতে ধরে নিয়ে এসেছেন টিসি নেওয়ার জন্য। তাঁদের মধ্যেই একজন বাসন্তী টুডুকে দেখা গেল রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন। কী হয়েছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। চিত্তরঞ্জনের এমএস স্কুলে ভর্তি হতে বলা হয়েছে। সেখানে মেয়েকে পাঠানো সম্ভবই নয়। এখন কোথায় মেয়েকে ভর্তি করব বুঝতে পাচ্ছি না।’’
মন ভার করা পড়ুয়াদের চোখের জল দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি অঙ্কের শিক্ষক বিদ্যুৎ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘৩২ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। এমন দিন দেখতে হবে কল্পনাও করিনি।’’ উদাস ভাবে স্কুলের দিকে তাকিয়ে তিনি জানালেন, ১৯৫৮ সাল থেকে এই ভবনে স্কুল চলছে। শুক্রবার সব শেষ হয়ে গেল!