রাতের শহর

ছুটছে দু’চাকা, রাতের ধাবায় গোপন ঠেক

একের পর এক দোকানের ঝাঁপ বন্ধ বচ্ছে। কমছে যাতায়াত। আর বাড়ছে মোটরবাইকের দাপাদাপি। কখনও মাঝরাতে কৃষক সেতুর পাশে মোটরবাইক থামিয়ে গুলতানি, কখনও রাস্তার ধারের ধাবা বা বারের সামনে জমাট আসর।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:৪৯
Share:

রাস্তার পাশে সার দিয়ে মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে চলছে আসর। নিজস্ব চিত্র।

একের পর এক দোকানের ঝাঁপ বন্ধ বচ্ছে। কমছে যাতায়াত। আর বাড়ছে মোটরবাইকের দাপাদাপি।

Advertisement

কখনও মাঝরাতে কৃষক সেতুর পাশে মোটরবাইক থামিয়ে গুলতানি, কখনও রাস্তার ধারের ধাবা বা বারের সামনে জমাট আসর। একটু দাঁড়ালে শোনা যায় ভেতর থেকে ভেসে আসছে সুরেলা কণ্ঠ, ঝাঁঝালো গন্ধ।

বৃষ্টিতে তখন আবছা উল্লাস, নবাবহাট মোড়। শুধু দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে সশব্দে ছুটে যাচ্ছে দূরপাল্লার ট্রাক। বর্ধমান শহরের ভেতরের জিটি রোড থেকে ওই দুই মোড় পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার জুড়ে উড়ছে ‘রাত জাগা পাখিরা’। তিনকোনিয়া এলাকার আবহও আবগারি।

Advertisement

চাপাটি, আলুর পরোটার সঙ্গে তরকার ঝাঁঝ, কষা মাংসের গন্ধ ছাপিয়ে উড়তে থাকে মদের গন্ধ। বিয়ার-বাংলা, দেশি-বিদেশি মিলেমিশে একাকার। সঙ্গে রয়েছে পাউচ প্যাকেট! যা ছিঁড়ে গলায় ঢালতে সময় লাগে না। শহর ছাড়িয়ে কলকাতা বা দুর্গাপুরের দিকে এগোতেই প্রায় সমস্ত ধাবাতেই এ দৃশ্য চেনা। রাত দেড়টা-দুটো পর্যন্ত একের পর অর্ডার যাচ্ছে রুটি-কষা মাংস আর বোতলের।

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর কয়েকটা ধাবার ভিতর আবার ‘চেম্বার’ রয়েছে। কান পাতলেই সুরেলা কন্ঠ শোনা যায়। একটু দাঁড়াতে শোনা গেল, ‘আর কতক্ষণ বসব? তাড়াতাড়ি দিয়ে যাও” কিছুক্ষণ পরে ধাবার এক কর্মী নামী ব্রান্ডের হুইস্কি আর কষা মাংস ওই ‘চেম্বারে’ নিয়ে গেলেন। সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট। এক পা এগোতেই ধাবা-কর্মীর আমাদের সন্দেহের চোখ ধরে ফেললেন। নিচু গলায় তিনি বললেন, “পাঁচ তরুণী মাঝেমধ্যে রাতের দিকে আসে। মদ-মাংস খেয়ে বর্ধমান ফিরে যায়।” হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, বড়শিতে টাকাটা ভালই গাঁথেন। ভেতরে তখন বাজছে ‘ইয়ে লাল রং কব মুঝে ছোড়ে গা...’।

রাত বাড়তে থাকল। উল্লাস মোড়ের কাছে একটি বারের সামনে তরুণ-তরুণীদের হুল্লোড় কমতে থাকল ধীরে ধীরে। আরও একটু পরে দামী মোটরবাইকে জোড়ায় জোড়ায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তারা। উল্লাস বাসস্ট্যান্ডেও নিঝুম রাত। ভেতরে ঢুকতেই আওয়াজ বুঝিয়ে দিল, মদের ঠেক শেষ হয়নি।

মোটরবাইক ঘুরিয়ে পুলিশ বাজার হয়ে এ বার গন্তব্যস্থল তিনকোনিয়া। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে দু’তিনটি হোটেলে আলো জ্বলছে। লোকজনও রয়েছে। মোটরবাইকের স্টার্ট বন্ধ করে হাজির হওয়া গেল একটি দোকানের শেডের নীচে। কম আলোতেও চোখে পড়ল সস্তার শাড়ি, লিপস্টিক-টিপ, ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে ৪-৫ জনের তিন-চারটে মহিলার দল। হাতে গাঁদা ফুলের মালা নিয়েও কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিলেন। বৃষ্টি কমতেই জিটি রোডের ডিভাইডারে গিয়ে দাঁড়ালেন নীল-হলুদ শিফনের শাড়ি পড়া বছর বত্রিশের এক মহিলা। গুরুদুয়ারের সামনে ট্রাক দাঁড়াতেই চালকের সঙ্গে কথা বলে হারিয়ে গেলেন। কাছেই রিকশায় বসে রয়েছেন দু’জন। ঠান্ডা পানীয়ের বোতল থেকে গলায় কী যেন ঢালছেন। রিকশা চালকের জিজ্ঞাসা, ‘তিতলি কই?’ উত্তর এল, ‘খেপ খেলতে গিয়েছে।’ বিরক্তির সুরে রিকশা চালক বলে উঠল, ‘ভাল খদ্দের ছিল, আমদানি বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেল।’ কিছুক্ষণ দেখে বোঝা গেল গাঁদা ফুল যার উপর পড়ছে, সেই সরে যাচ্ছে।

কয়েক মাস আগে, জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার ছদ্মবেশে হানা দিয়েছিলেন এই এলাকায়। আটকও করেছিলেন কয়েকজনকে। কিন্তু কিছুই যে বদলায়নি বোঝা গেল।

এ বার নবাবহাট বাসস্ট্যান্ড। বিদ্যুৎ নেই। নিকষ অন্ধকার ভেতরে ঢোকার সাহস হল না। মনে পড়ে গেল, এ রকম রাতেই তো শহরের ভিতর একের পর এক এটিএম লুঠ হয়েছিল। পুলিশ টহলদারি বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিল। সব গেল কোথায়? দেখতে পেলাম না। চোখের ভুল!

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন