Asansol

‘সংস্থা’ যেন ইসিএলের সমান্তরাল

সিবিআই সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০১১-র পরে, লালার সিন্ডিকেটে নাম জুড়ল বাঁকুড়ার নীরদবরণ মণ্ডল, পুরুলিয়ার গুরুপদ মাজি, রানিগঞ্জের নারায়ণ নন্দা এবং পুরনো কয়লা কারবারি আসানসোলের জয়দেব মণ্ডলের।

Advertisement

সুশান্ত বণিক

আসানসোল শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:০৭
Share:

কয়লার বেআইনি সাম্রাজ্যের বাদশা বদল ঘটেছে।

২০১১-য় রাজ্যের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এর সঙ্গে কয়লার বেআইনি কারবারে লাগাম পড়েনি। উল্টে তা ‘বেড়েছে’। তবে কয়লার বেআইনি সাম্রাজ্যের বাদশা বদল ঘটে— রাজেশ ওরফে রাজু ঝায়ের বদলে শোনা গেল নতুন নাম, পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ার অনুপ মাজি ওরফে লালা। সে সঙ্গে বছর আড়াই আগে শুরু হয় সিবিআই তদন্ত। তদন্তের সূত্রে উঠে আসে লালার কয়লা-সিন্ডিকেটের কথা। জানা যায়, এই সিন্ডিকেটে জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকও!

Advertisement

সিবিআই সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০১১-র পরে, লালার সিন্ডিকেটে নাম জুড়ল বাঁকুড়ার নীরদবরণ মণ্ডল, পুরুলিয়ার গুরুপদ মাজি, রানিগঞ্জের নারায়ণ নন্দা এবং পুরনো কয়লা কারবারি আসানসোলের জয়দেব মণ্ডলের। অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট জায়গায় বেআইনি ভাবে কয়লা তোলা হতে থাকে এদের মদতেই। সিবিআইয়ের চার্জশিটে উল্লেখ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, নেপাল, বাংলাদেশ-সহ নানা জায়গায় কয়লা পাচারের দায়িত্ব ছিল কুলটির বড়তোড়িয়ার বাসিন্দা রত্নেশ বর্মার উপরে। সিবিআই সূত্রে দাবি, এই গোটা সিন্ডিকেটে নাম জড়িয়েছে ইসিএল, পুলিশ, রেলের আধিকারিক এবং ‘প্রভাবশালীদের’ও। এই অংশটির কাছে টাকা পৌঁছনোর দায়িত্বে ছিলেন নারায়ণ। টাকা লেনদেনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যুব তৃণমূল নেতা বিনয় মিশ্র ও তাঁর ভাইবিকাশ মিশ্রের।

মূলত তিন ভাবে কয়লা চুরি হত বলে তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন— প্রথমত, অবৈধ খননের সঙ্গে ইসিএলের বৈধ কয়লা চুরি হত। দ্বিতীয়ত, জল মিশিয়ে কয়লা চুরি করা হত। তৃতীয়ত, রেল সাইডিং থেকে মালগাড়ির রেকে কয়লা তোলার আগে চুরি।

Advertisement

ইসিএলের কয়েক জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর মতে, রাজু থেকে লালা, এই পর্বে কয়লা-চুরি আরও সংগঠিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে লালার সিন্ডিকেটের অফিস। পশ্চিম বর্ধমানের পাশাপাশি, ঝাড়খণ্ডের মুগমা, রাজমহল, নলা প্রভৃতি এলাকাতেও বিস্তৃত হয় লালার সিন্ডিকেট। প্রবীণ খনিকর্মীদের মতে, লালার কারবার দেখে মনে হত যেন, ইসিএলের পাশে, সমান্তরাল আরেকটি ‘সংস্থা’ চলছে!

উল্টো দিকে, কয়লা-তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ বছর হল ২০১৪। এই বছর ও তার পরে, ইসিএল জেলার বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে লিজ় হোল্ড এলাকা থেকে কয়লা চুরি, বৈধ ডিপো থেকে চুরি, সড়কপথ-রেলপথে পরিবহণের সময়ে চুরির অজস্র অভিযোগ দায়ের করে। ২০১৯-এ বিশেষ টাস্ক ফোর্স তৈরি করে ইসিএল। কোথায়, কী ভাবে চুরি, কারা জড়িত, কারা চুরি করা কয়লা ব্যবহার করছে— এমন তথ্য-সহ তিনশো পাতার একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল এই টাস্ক ফোর্স।

এ দিকে, কয়লা মন্ত্রকের হস্তক্ষেপে অবৈধ কয়লা কারবারের তদন্ত শুরু করে সিবিআই। ২০২০-র ২৭ নভেম্বর কয়লা চুরির প্রথম অভিযোগ দায়ের করে সিবিআই। ইসিএলের আধিকারিকদের বাড়িতে তল্লাশি, আট জন প্রাক্তন ও বর্তমান খনি কর্তা-কর্মী, জয়দেব, নারায়ণ, গুরুপদ ও নীরদবরণকে গ্রেফতার করে সিবিআই। কয়লা চুরির কারবারে যুক্ত থাকার অভিযোগে অনুপ-সহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে ২০২২-এর ১৯ জুলাই আসানসোল বিশেষ সিবিআই আদালতে প্রথম চার্জশিট জমা দেয় সিবিআই। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই তদন্তে সিবিআই প্রায় ১৭ জন রেলকর্মী, আধিকারিক এবং কয়েক জন পুলিশকর্তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল বলে সূত্রের দাবি।

এ বারে, সিবিআইয়ের সক্রিয়তার মাঝেই হঠাৎ গা-ঝাড়া দেয় রাজ্যের সিআইডি। সুমিত হালদার, আব্দুল বারিক বিশ্বাস, সঞ্জয় মালিক-সহ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। সিআইডি সূত্রে দাবি, জেরায় ধৃতেরা স্বীকার করেন, চুরি করা কয়লা বারিকের বসিরহাটের ইটভাটা ও রানিগঞ্জের স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় ব্যবহৃত হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় ইসিএলের তৈরি করা টাস্ক ফোর্সের প্রধান মেজর রাজা পাল-সহ তিন নিরাপত্তা কর্মীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। কিন্তু, কিছু দিন আগে কলকাতা হাই কোর্ট সিআইডি-র তদন্তে স্থগিতাদেশ দেয়।

এই পরিস্থিতিতে, সিবিআইয়ের তৎপরতায় লালার কারবারে ভাঁটা পড়ে। কিন্তু সে জায়গায় ফের উত্থান হচ্ছিল রাজুর। এখন প্রশ্ন হল এই কয়লা-সিন্ডিকেটের জন্ম কেন হল, এই চুরির কয়লা ব্যবহৃতই বা হত কোথায়। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন