ভারতীয় রেলের প্রথম বিনোদন ক্লাব

এখন নাম বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট। কিন্তু আসানসোলের মানুষের মুখে মুখে এটির নাম, ডুরান্ড ইনস্টিটিউট। তৈরি হয় ১৮৭৮ সালে। কয়লা-ভূমি আসানসোল নামের জনপদটির শহর হিসাবে গড়ে ওঠার সূচনা-পর্বে। এর সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের চোখ রাখতে হবে ইতিহাসের দিকে।

Advertisement

অরুণাভ সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:২০
Share:

ইতিহাসের সাক্ষী ডুরান্ড ইনস্টিটিউট। এখন বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। ছবি: শৈলেন সরকার

আসানসোলে জিটি রোড থেকে লোকোগ্রাউন্ড বা পূর্ব রেলের ডিভিশনাল রেলওয়ে স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে স্টেশন রোড ধরলেই ডান পাশে চোখে পড়বে মনোরম প্রাচীন স্থাপত্য। পাঁচিল ঘেরা অনেকখানি খোলা জায়গার মধ্যে সেটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর ব্রিটিশ শাসনের অস্মিতার অভিজ্ঞান নিয়ে।

Advertisement

এখন নাম বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট। কিন্তু আসানসোলের মানুষের মুখে মুখে এটির নাম, ডুরান্ড ইনস্টিটিউট। তৈরি হয় ১৮৭৮ সালে। কয়লা-ভূমি আসানসোল নামের জনপদটির শহর হিসাবে গড়ে ওঠার সূচনা-পর্বে। এর সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের চোখ রাখতে হবে ইতিহাসের দিকে।

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পুরুলিয়ার কাশীপুরের তৎকালীন মহারাজা তাঁর দুই বীর, সেনানী— নকড়ি ও রামকৃষ্ণ রায়কে বর্গিদের হানা প্রতিহত করার জন্য পুরস্কার হিসেবে শেরগড় পরগনার আসানসোল মৌজাকে জায়গির দিলেন। এখানেই পরে গড়ে উঠবে আসানসোল গ্রাম। তবে আসানসোল-রানিগঞ্জ অঞ্চলে কয়লা আবিষ্কার হয় ইংরেজরা আসার আগেই। জানা যায়, সপ্তদশ শতকেই লবণ ব্যবসায়ীরা মেদিনীপুর থেকে নুন নিয়ে এখানে আসতেন। ফিরে যেতেন নৌকা বোঝাই কয়লা নিয়ে। সভ্যতার বিকাশের অন্যতম অনুঘটক এই কয়লার উপযোগিতা বুঝতে দেরি হয়নি ইংরেজ বণিক তথা শাসকদের। অষ্টাদশ শতকের সত্তরের দশক থেকে বিদেশি বণিকদের উদ্যোগে রানিগঞ্জ থেকে শুরু হয় কয়লা উত্তোলন। প্রথম উদ্যোগ ১৭৭৪ সালে। এগিয়ে এসেছিলেন পালামৌ অঞ্চলের কালেক্টর সুইটোনিয়াস গ্রান্ট হিটলিস্টে, জন সামনার ও রেডফার্ন। পরে ফার্ক্যুহার এবং ম্যাট, জোনস, মেসার্স আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি, বেটস কোম্পানি, জেশপ অ্যান্ড কোম্পানি—অনেক নাম আছে।

Advertisement

এর মধ্যে উজ্জ্বল এক ভারতীয় নাম, দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি বন্ধু উইলিয়াম কার-কে নিয়ে ‘কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি’ তৈরি করে রানিগঞ্জে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন।

তখন পরিবহণ হতো জলপথে। প্রধানত, দামোদর এবং তার সঙ্গে অজয় দিয়ে কয়লা যেত কলকাতায়। কিন্তু নদীর জল কম থাকলে পরিবহণে সমস্যা হতো। অতএব রেলপথ তৈরির কথা ভাবা হল। তাতে লাভ, কয়লা পরিবহণের পাশাপাশি সৈন্যও যেতে পারবে।

ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানির পত্তন ১৮৪৫ সালে। ১৮৫৫ সালে হাওড়া থেকে ১৯৪ কিলোমিটার দূরে তৈরি হল রানিগঞ্জ স্টেশন।

এর পরে রানিগঞ্জ এগোল নগরায়নের পথে। পুর-শহর হিসেবে স্বীকৃতি এল ১৮৭৬ সালে। আসানসোল পুর-শহরের তকমা পাওয়ার ন’বছর আগেই। কিন্তু সে সব পরের কথা। রানিগঞ্জ রেলস্টেশন তৈরির পরে সেখানে পণ্য পরিবহণ-সহ নানা কাজের চাপ বাড়তে থাকে। রেল কর্তৃপক্ষ রানিগঞ্জ স্টেশন ও তাকে কেন্দ্র করে পরিকাঠামো বাড়াতে চাইলেন। কিন্তু জায়গা মিলল না। পরিবেশ দূষণ-সহ অন্যান্য নানা ভাবনায় পিছিয়ে গেলেন তৎকালীন ভূস্বামীরাও।

জমি পাওয়া গেল আসানসোলে। কাশীপুরের রাজা তাঁর শেরগড় পরগনার বনাঞ্চল বিক্রি করলেন রেল কর্তৃপক্ষকে। রেলপথ তৈরি হল আসানসোল পর্যন্ত। ১৮৬৩ সালে তৈরি হল আসানসোল স্টেশন। প্রথমে পুরনো স্টেশন। পরে বর্তমানের অবস্থানে। পরে রেলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হতে থাকে আসানসোল। ভবিষ্যতে সেখানে শুরু হবে শিল্পস্থাপনের প্রস্তুতি।

এর পরে দরকার হল বিনোদনের। তখন রেলের ইঞ্জিনিয়ার, মধ্য বা উচ্চপদস্থ কর্মী— সবাই ইউরোপীয় অথবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তাঁদের জন্য একটি বিনোদনমূলক ক্লাব দরকার। সেই প্রয়োজনে মেটাতে ১৮৭৮ সালে তৈরি হল বর্তমানের আলোচ্য স্থাপত্য।

১৯১৫ সালে এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট’। ১৯২৫ সালে এর নাম হয় ‘ডুরান্ড ইনস্টিটিউট’, সেই সময়ের এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব স্যার হেনরি মর্টিমার ডুরান্ড (১৮৫০-১৯২৪) এর নামে। ডুরান্ড ছিলেন এক কুশলী ও সফল ‘সিভিল সার্ভেন্ট’ এবং পরে রাজদূত। ছিলেন ‘An Autumn Tour in Western Persia (১৯০২)’, ‘Nadir Shah: An Historical Novel (১৯০৮)’ ইত্যাদি গ্রন্থের লেখকও। তবে খ্যাতি পান ‘ডুরান্ড লাইন’ তৈরি করে, যা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মধ্যে ২,৬৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নির্ধারণ করছে। ব্রিটিশ-ভারতের আমলে ডুরান্ড ইনস্টিটিউটের গরিমাই ছিল আলাদা। কারণ, এটি ছিল পুরো ভারতীয় রেলওয়ের প্রথম বিনোদন-ক্লাব। এর কেন্দ্রে প্রস্তুত করা হয়েছিল নাচের জন্য এক বিরাট ডান্স-হল, যার মেঝে সেগুন কাঠে তৈরি। তা ছাড়া ছিল বার, লাউঞ্জহল, ক্লোকরুম, লাইব্রেরি, প্রশস্ত শৌচাগার। ছিল বিলিয়ার্ড, স্নুকার, ব্যাডমিন্টন ও টেনিস খেলার ব্যবস্থা।

অভিজাত এই ক্লাবের কৌলিন্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল অনেক দূর পর্যন্ত। তার আঁচ নিতে দূর থেকেও ছুটে আসতেন অনেকে। বিশেষ করে বড়দিন ও উৎসবের দিনে সম্ভ্রান্ত এই ক্লাবের ডান্সহলে নাচে যোগ দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন সবাই। ছিল পোশাক বিধি বা ‘ড্রেস কোড’ও। তবে ভারতীয়দের এখানে প্রবেশাধিকার ছিল না।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে এখানে প্রথম প্রবেশাধিকার মেলে ভারতীয়দের। ‘পোশাক বিধি’ ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত চালু ছিল। তার পরে বহু দিন এটি প্রেক্ষাগৃহ হিসেবে চলেছে। তখন প্রতি বছর ১৫ অগস্ট এখানে সিনেমা দেখানো হত বিনামূল্যে।

অনেকের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে ষাটের দশকে এখানে প্রদর্শিত ‘বেন-হার’, ‘টেন কম্যান্ডমেন্টস’-এর মতো সে সময়ের বিখ্যাত হলিউডি সিনেমাগুলির কথা। ১৯৮৭ সালে ডুরান্ড ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে নাম দেওয়া হয় ‘বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট’। এর প্রবেশপথ সংলগ্ন স্তম্ভটি তৈরি হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হত ইউরোপীয় সৈনিকদের স্মৃতিতে। কিছু নামের উল্লেখ-সহ স্মৃতিজড়িত তাম্রফলকের একটি উৎসর্গপত্র প্রোথিত আছে স্তম্ভের ভিতরের দিকের দেওয়ালে। সামনে স্টেশন রোডের ব্যস্ততা। এই কালস্রোতের সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে অতীতের ‘ডুরান্ড ইনস্টিটিউট’।

লেখক চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন