বর্ধমান মেডিক্যাল

প্যাকেজই প্রণামী, বলছে দালাল

সবাই জানে, তাঁরা আছেন। হাসপাতালের আনাচে-কানাচে তাঁদের অবাধ বিচরণ। তাঁদের উপস্থিতির কথা বিলক্ষণ জানেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। তবু, তাঁদের দাপট কমে না।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:১৩
Share:

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ

সবাই জানে, তাঁরা আছেন। হাসপাতালের আনাচে-কানাচে তাঁদের অবাধ বিচরণ। তাঁদের উপস্থিতির কথা বিলক্ষণ জানেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। তবু, তাঁদের দাপট কমে না। মাঝেমধ্যে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, তা নয়। কিন্তু, সে-সবে পাত্তাই দেন না তাঁরা!

Advertisement

তাঁরা ‘দালাল’। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে ঘুরলেই বোঝা যায়, এই দালালদের নীরব (প্রয়োজনে সরব) উপস্থিতি। কোন রোগীকে পাকড়াও করলে মোটা দাঁও মারা যাবে, তাঁদের অভিজ্ঞ চোখ ঠিক তা ঠাওর করে নেয়। এবং ঝোপ বুঝে কোপ মারা শুরু! এমনই এক ‘নামী’ দালালকে মঙ্গলবার ‘টোপ’ দিয়ে ধরেছেন খোদ হাসপাতাল সুপার উৎপল দাঁ। তাঁকে প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করার পাশাপাশি, হাসপাতালে ঢুকতে বারণ করে দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু, তাতে কি আসল রোগ কমবে? বর্ধমান মেডিক্যাল বা তার সুপার স্পেশ্যালিটি বিভাগ অনাময়ে আসা রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলছে। যেমন, বীরভূমের মুরারইয়ের জাহিরুলা বিবি (নাম পরিবর্তিত)। এমআরআই করানোর জন্য বারো বছরের ছেলেকে নিয়ে এসেছেন তিনি। জানালেন, প্রয়োজনীয় নথি দেখিয়ে কাগজ নিয়ে ঘোরার পথেই এক ব্যক্তি তাঁকে বলেন, ‘বাইরে এমআরআই করতে খরচ সাড়ে চার হাজার টাকা। আমাকে বললে দেড় হাজার টাকার মধ্যেই সব করে দেব’। ছেলের চিকিৎসার স্বার্থে কিছু না ভেবেই ওই দালালের হাতে কাগজপত্র ও টাকা দিয়ে দিয়েছেন তিনি। তিনি জানেনই না, সরকারি হাসপাতালে এমআরআই হয় নিখরচায়!

Advertisement

আগে হাসপাতালের রোগীদের নানা রকম পরীক্ষা বাইরে করানো হত বলে বারবার অভিযোগ উঠত। এখন উল্টো ঘটনা ঘটছে। চিকিৎসকের চেম্বার থেকেই রোগীকে ‘পাকড়াও’ করে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি থেকে সব রকম পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত ‘প্যাকেজ’! ‘‘রোগীর চিকিৎসা প্রয়োজন। বাইরে থেকে চিকিৎসা করালে হাজার হাজার টাকা খরচ। সে কথা বুঝিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসি। সব দায়িত্ব আমাদের। তার বদলে আমরা প্রণামী নিয়ে থাকি।’’—বুধবার হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন এক দালাল। প্রণামী? তাঁর কথায়, ‘‘প্যাকেজকে আমরা প্রণামী-ই বলি।’’

এই দালালদের ‘অপারেশন’ কায়দাও অভিনব। হাসপাতাল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, মুমূর্ষু কোনও হৃদরোগীকে অনাময় হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তির ‘টোপ’ দেওয়া হয়। ভর্তির জায়গা নেই বলে বর্ধমান মেডিক্যালের টিকিটের উপরে হয়তো চিকিৎসক লিখে দিয়েছেন, ‘রোগী স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছেন’। সেই টিকিটের উপরেই ওই লেখা কেটে ‘রেফার টু কার্ডিওলজি’ লিখে দেওয়া হয়। যা দেখিয়ে অনাময়ে চিকিৎসা শুরু হয়ে যায় রোগীর। বিনিময়ে দালালদের পকেট ভরে। মেডিক্যালের ওই টিকিটে কাটাকুটি দেখে অনাময়ের চিকিৎসকদের সন্দেহ হলে অন্য দাওয়াই। অনাময় হাসপাতালের কাছেই থাকা একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নতুন করে টিকিট করিয়ে ‘রেফার’ করিয়ে আনেন দালালরা। রোগীকে তখন পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকেন চিকিৎসকেরা।

বর্ধমান মেডিক্যাল ও অনাময় হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্তৃপক্ষের দাবি, হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মীরাই এ সব ঘটনায় যুক্ত। ওই সব কর্মী ১০-১৫ বছর থেকে রীতিমতো মৌরসিপাট্টা গেড়েছেন। তাঁদের একাংশই জুনিয়র ডাক্তারদের ‘ভুল বুঝিয়ে’ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন বলে ওই কর্তার দাবি। নাম গোপন রাখার চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী বলেন, ‘‘দালালদের গতিবিধি অবাধ। কে দালাল আর কে নয়, সেটা বোঝাই দায়!’’ হাসপাতালের কর্মী হওয়ায় রাজনৈতিক নেতাদেরও মদতও থাকে বলে অভিযোগ।

ডেপুটি সুপার অমিতাভ সাহা বলেন, ‘‘লিখিত অভিযোগ থাকে না বলে সব সময় কড়া ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে আমাদের গোচরে এলে প্রথমে অভিযুক্ত কর্মীকে সতর্ক করা হয়। পরে বদলি করা হয়।’’ হাসপাতাল সুপার উৎপলবাবুর কথায়, ‘‘দালাল-রাজের কথা আমাদের জানা নেই, এমন দাবি করছি না। সে জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে কর্মীদের পরিচয়পত্র ঝোলানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুইপারদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে ঘুরছি। তার পরেও ঘটনা ঘটছে। এই চক্র ভাঙার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন