কারখানার গেটে কর্মীদের উচ্ছ্বাস। ছবি: শৈলেন সরকার।
হাসিমুখে এর আগে কবে দিন শুরু করেছেন, ভুলেই গিয়েছেন তাঁরা। কোনও ভাল খবর পাওয়াটাই যে তাঁদের কাছে একটা অসম্ভব বিষয়ের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মঙ্গলবারের সকালের খবরটা তাই তাঁদের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কারখানা খোলার ব্যাপারে আশার আলো দেখা দিয়েছে, এ খবর পাওয়ার পরেই আনন্দে ভাসলেন রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেব্লস কারখানার শ্রমিক-কর্মী থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা। মঙ্গলবার সকালে রূপনারায়ণপুরে গিয়ে দেখা গেল, সর্বত্র খুশির মেজাজ। এমনিতেই কারখানার উৎপাদন বন্ধ বেশ কয়েক বছর। তাই কারখানায় আস-যাওয়ার তেমন তাড়া থাকে না কর্মীদের মধ্যে। কারখানার গেটেও কড়াকড়ির বালাই নেই। কিন্তু মঙ্গলবারের ছবিটা ছিল একেবারে অন্য রকম। সকাল ৮টার আগেই কয়েকশো শ্রমিক-কর্মী কারখানার গেটে হাজির হন। সকলেই বেশ উৎফুল্ল। কিছুক্ষণ পরেই কারখানা চত্বর-সহ আশপাশের অঞ্চল একেবারে উৎসবের চেহারা নেয়। শুরু হয়ে যায় আবির খেলা। এসে গেল মিষ্টিও। অনেকেই আবার স্লোগান দিলেন আসানসোলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়ের নামে।
সংস্থার দীর্ঘ দিনের কর্মী দেবতোষ মুখোপাধ্যায় জানান, অনেক বছর হয়ে গেল, তাঁরা প্রাণ খুলে হাসতে ভুলেই গিয়েছিলেন। দশ মাসের বেতন বাকি। সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, “বিশ্বাস করুন, এই রকম একটা দিন আসবে, সে স্বপ্নও দেখতে ভুলে গিয়েছিলাম। দিন দিন যেন অন্ধকারে আরও গাঢ় হচ্ছিল।” কারখানার আর এক কর্মী ইন্দ্রাণী সরখেল বলেন, “এ বার বাঁচার আলো দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, অনেক দিন পরে ঘুড়ে দাঁড়াতে পারব আমরা।”
কারখানার পুরনো দিনের কথা স্মরণ করে তাঁদের সবার গলায় আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে। তাঁরা জানান, সকাল-বিকেল হাজার-হাজার শ্রমিক-কর্মী কারখানায় আসা-যাওয়া করতেন। সেই দৃশ্য এখন ভুলতে চলেছে কারখানা। এ বার আবার ফিরে আসবে সেই ছবি, বিশ্বাস তাঁদের। রূপনারায়ণপুর শহরের পুরনো বাসিন্দা, পরিবহণ ব্যবসায়ী নিবাসচন্দ্র মণ্ডল জানান, তিরিশ বছর আগেও এই শহরটা ছিল দেখার মতো। ঝাঁ চকচকে রাস্তা ও কর্মী আবাসন। রাতে নিয়ন বাতির আলোয় শহর যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠত। তিনি বলেন, “কারখানার অবস্থা খারাপ। তাই ব্যবসাও পড়ে গিয়েছে। কারখানার দিন ফিরলে আবার পুরনো দিন ফিরে পাব, সেই আশায় আছি।” কেব্লস স্কুলের অধ্যক্ষ সুভাষচন্দ্র বিশ্বাসের মতে, কারখানার হাল ফিরলে স্কুলগুলিও আগের রমরমায় ফিরবে।
এক সময়ে কেব্লসের মাঠ দাপিয়েছেন কারখানার ফুটবল দলের সদস্য অজিত ঘোষ। তাঁর আক্ষেপ, “কারখানা বেহাল হয়ে পড়ার পরে খেলাধুলোই উঠে গেল। মাঠ আছে, কিন্তু পরিচর্যা হয় না। খেলার লোকও নেই।” তাঁর দাবি, “আসলে, নতুন প্রজন্মের কাছে তো কোনও দিশা নেই। কারখানা খোলা থাকলে চাকরি পাওয়ার আশা থাকে। কারখানার পুনরুজ্জীবন হলে মাঠগুলো হয়তো আবার ভরবে।” কেব্লস শহরে একাধিক প্রেক্ষাগৃহ আছে। কারখানার তত্ত্বাবধানেই সেগুলি চলত। প্রতিদিনই সেখানে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগে থাকত। সে সব এখন প্রায় ধ্বংশাবশেষে পরিণত। প্রেক্ষাগৃহের সাংস্কৃতিক কর্মী অখিল মজুমদার বলেন, “কারখানার দিন ফিরলে অতীতের সাংস্কৃতিক পরিবেশও ফিরে আসবে।”
কেবলস কারখানার অধিগ্রহণ ও পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্তে খুশি সংস্থার শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও। বিএমএস নেতা বিশ্বনাথ রায়ের দাবি, “কেন্দ্রীয় সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে, তারা শিল্পবান্ধব। যে কাজ এত দিন আটকে ছিল, তা এ বার দ্রুততার সঙ্গে হবে।” আইএনটিইউসি নেতা উমেশ ঝা-র যদিও বক্তব্য, “প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এক বছর আগেই অধিগ্রহণের সম্মতি দিয়েছে। এই সরকার সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশা রাখি।” সিটু নেতা প্রদীপ সাহা বলেন, “কারখানার পুনরুজ্জীবনে এই সরকার যে ইতিবাচক পদক্ষেপ করেছে, তা ভাল দিক।” সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কেব্লস অফিসার্স অ্যাসোশিয়েসনের সদস্যেরাও।