গ্রাম দখলের লড়াই, প্রাণ গেল বাবা-ছেলের

দু’দলের গ্রাম দখলের লড়াইয়ে প্রাণ গেল এক গোষ্ঠীর বাবা-ছেলের। রাতভর চলল বোমাবাজি। সকালে গ্রামের দুই এলাকা থেকে দু’জনের দেহ উদ্ধার করল পুলিশ। সোমবার রাতে মন্তেশ্বরের পাকুড়মুড়ি গ্রামের ওই ঘটনায় ১৭ জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন নিহত জীবন বসুর (৬৯) স্ত্রী সন্ধ্যা বসু। তাঁর দাবি, স্বামী ও ছোট ছেলে নব বসুকে (২৫) খুন করেছে রবি ঘোষের দলবল। মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ গ্রামে অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেফতারও করেছে। তবে বাকি অভিযুক্তেরা এলাকাছাড়া।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মন্তেশ্বর শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:২৬
Share:

নিহতদের পরিজনের কান্না। নিজস্ব চিত্র।

দু’দলের গ্রাম দখলের লড়াইয়ে প্রাণ গেল এক গোষ্ঠীর বাবা-ছেলের। রাতভর চলল বোমাবাজি। সকালে গ্রামের দুই এলাকা থেকে দু’জনের দেহ উদ্ধার করল পুলিশ।

Advertisement

সোমবার রাতে মন্তেশ্বরের পাকুড়মুড়ি গ্রামের ওই ঘটনায় ১৭ জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন নিহত জীবন বসুর (৬৯) স্ত্রী সন্ধ্যা বসু। তাঁর দাবি, স্বামী ও ছোট ছেলে নব বসুকে (২৫) খুন করেছে রবি ঘোষের দলবল। মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ গ্রামে অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেফতারও করেছে। তবে বাকি অভিযুক্তেরা এলাকাছাড়া।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুই গোষ্ঠীর দুই নেতা আশিস মণ্ডল ও রবি ঘোষের মধ্যে গ্রামের দখল নিয়ে ঝামেলা ছিলই। বছর চারেক আগে মতপার্থক্য চরমে ওঠে। বিধানসভা ভোটের পর থেকে পাকুড়মুড়ি কার্যত দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে ওঠে। গ্রামবাসীরা জানান, সে সময় রাতের সঙ্গী হয়ে যায় বোমা-গুলির শব্দ। দুই গোষ্ঠীই বাইরে থেকে ভাড়াটে গুন্ডাও আনতে শুরু করেছিল। দু’পক্ষই বোমাবাজি করে গ্রামের দখল নিতে চাইত। পরে আশিস মণ্ডলের লোকজনেরা গ্রামছাড়া হয়ে যায়। নিহত জীবন বসু (৬৯) ও তাঁর পরিবার ওই আশিস মণ্ডলেরই অনুগামী ছিলেন। কিছুদিন পরে অবশ্য ক্ষমতা বাড়িয়ে ফিরেও আসে আশিসের গোষ্ঠী। তার মধ্যেই বছর দুয়েক আগে গ্রামের এক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো নিয়ে ফের দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ বার আশিস মণ্ডলের গোষ্ঠী এলাকাছাড়া করে রবি ঘোষের দলবলকে।

Advertisement

তবে লোকসভা ভোটের মাস তিনেক আগে থেকেই রবি ঘোষের লোকজনেরা প্রশাসনিক মহলে গ্রামে ঢুকতে না পারায় অভিযোগ জানাতে শুরু করে। তাঁদের দাবি, তাঁরা প্রায় ৪০ জন গ্রামে ঢুকতে পারছেন না, সম্পত্তি, বাড়িঘর লুঠ হয়ে যাচ্ছে। লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে চেয়ে গ্রামে ঢোকার আবেদন করেন তাঁরা। এরপরে মহকুমাশাসক, বিডিও এবং পুলিশ রবি ঘোষের দলবলকে গ্রামে ফেরায়। কিন্তু ভোট মিটতেই পরিস্থিতি ফের উত্তপ্ত হতে শুরু করে। রবি ঘোষের জনা দশেক অনুগামী গ্রামে থাকলেও বাকিরা ফের গ্রামছাড়া হয়ে যায়।

জীবনবাবুর পরিবারের দাবি, সোমবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বাবা-ছেলে বাড়ি থেকে রাতের খাওয়া সেরে কাছাকাছি একটি পুকুরে জল ছেঁচে মাছ ধরতে যায়। সকালে সেই মাছ আড়তে বিক্রি করার কথা ছিল। তাঁদের সঙ্গে জীবনবাবুর বড় ছেলে বাপন-সহ আরও দশ-বারো জনেরও যাওয়ার কথা ছিল। বাপন বলেন, “বাবা আর ভাই আগেই গিয়েছিল। আমিও যাচ্ছিলাম। বাকিদেরও খাওয়া সেরে আসার কথা ছিল। কিন্তু কিছুটা যেতেই জোরালো বোমার আওয়াজ পাই। তারপরেই হৈ চৈ শুরু হয়। দ্রুত আড়ালে সরে গিয়ে দেখি রবি ঘোষের অনুগামীরা বোমা ফাটাতে ফাটাতে গ্রামের দখল নিচ্ছে। প্রাণ ভয়ে পাশের গ্রামের দিকে দৌড় দিই। সকালে জানতে পারি, ভাই ও বাবাকে নৃসংশ ভাবে খুন করা হয়েছে।” জীবনবাবুর দিদি বন্দনা বাগেরও দাবি, “রাতে আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু বাইরে একের পর এক বোমার আওয়াজ পাই।” তিনি বলেন, “জীবনের বাড়িতে সাড়ে ১১টা নাগাদ হুমকি দেয় ওরা। বোমা মেরে অ্যাসবেসটসের ছাদও ভেঙে দেয়। বুঝতে পারি রবি ঘোষের গ্রামের দখল নিচ্ছে। সারা রাত তাণ্ডব চলে।” সকালে গ্রামের দক্ষিণ মাঠে জীবনবাবুর ও কিছুটা দূরে দাসপাড়া এলাকায় নবর দেহ মেলে। বন্দনাদেবীর সন্দেহ, ওই দু’জনকে তাড়া করে খুন করা হয়েছে।

রাতভোর বোমাবাজির পর শুনশান গ্রাম।

বেলা ১২টা নাগাদ গ্রামে গিয়েও দেখা যায়, বেশিরভাগ বাড়িই তালাবন্ধ। কয়েকটা বাড়িতে মহিলারা থাকলেও গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য, থমথমে। ১টা নাগাদ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কালনার এসডিপিও এবং মন্তেশ্বরের ওসির নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী গ্রামে অভিযান চালায়। একজনকে গ্রেফতারও করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “মৃত বাবা-ছেলের নামেও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এদের ভয়ে এলাকার অনেকেই গ্রামছাড়া ছিলেন। ভোটের আগে অনেককে গ্রামে ফিরিয়েও আনা হয়েছিল।”

পরে নিহত জীবনবাবুর বড় ছেলে বাপন দাবি করে, “দু’পক্ষই তৃণমূলের সমর্থক। দলের উচুঁ নেতারা আগেই মীমাংসা করে দিলে এ রকম ঘটনা ঘটত না।” তবে তৃণমূলের মন্তেশ্বর ব্লক সভাপতি সজল পাঁজা বলেন, “এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। দু’জনেই সমাজবিরোধী। আমি শুনেছি, রবি ঘোষের লোকেরাই খুন করেছে।”

স্বামী ও ছেলে হারিয়ে সন্ধ্যাদেবী বলেন, “গ্রামের আর সবার সঙ্গে দীঘা যাওয়ার কথা ছিল নবরও। কিন্তু ছেলের অসুখের কারণে যেতে পারেনি। গেলে হয়তো ছেলেটা প্রাণে বেঁচে যেত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন