উমাদেবী। —নিজস্ব চিত্র।
পরনে সুতির ছাপা, গায়ে ময়লা চাদর। হাতে পুঁটুলি নিয়ে একটি বাড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন মধ্যবয়স্কা মহিলা। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। দিন দুয়েক আগে এ অবস্থায় ওই মহিলাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যান কাটোয়ার সাহেববাগানের উইলিয়াম কেরি লাগোয়া এলাকার বাসিন্দারা। মুহূর্তে মনে পড়ে যায়, বছর তিনেক আগেও তাঁদের পড়শি ছিলেন ওই মহিলা। তারপর থেকে পুরনো পড়শিকে আগলে রেখেছেন তাঁরাই।
এলাকার বাসিন্দারাই জানান, ওই পাড়াতেই থাকতেন বছর তিপান্নর উমা দাস ও তাঁর ছেলে রাহুল। তবে বছর তিনেক আগে বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে যান তাঁরা। রাহুল হাওড়ার সালকিয়াতে একটি বস্ত্র ডিজাইনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। আর মেয়ে বর্তমানে রাজস্থানের জয়পুরের বাসিন্দা। পড়শিদের দাবি, উমাদেবী তাঁদের কাছে অভিযোগ করেছেন যে, ছেলে বাড়ি বিক্রির সমস্ত টাকা, বিমার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এমনকী খেতে না দিয়ে দরজায় তালা মেরে একটি ঘরে আটকে রাখা হত তাঁকে। অভিযোগ শুনে বাসিন্দারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রাহুল কলকাতায় একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। উমাদেবীর উপর নির্যাতনের কথা জানতে পেরে ওখানকার একটি ক্লাবের ছেলেরা তাঁর উপর চড়াও হয়। তারপর ওই বাসা ছেড়ে সালকিয়াতে চলে যান রাহুল। উমাদেবীর আরও অভিযোগ, “দেড় বছর আগে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। সেই সময় চিকিৎসার বদলে আমাকে কাটোয়ার ট্রেনে তুলে দেয় আমার ছেলে।”
এরপরে কাটোয়া পৌঁছে শহরের বিভিন্ন আশ্রমে থাকতেন উমাদেবী। কখনও কারও বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেও দিন কাটাতেন। পেট ভরাতে ভিক্ষেও করতে হয়েছে তাঁকে। তবে বেশ কয়েক দিন ধরেই সাহেববাগান লাগোয়া বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় তাঁকে। কখনও সমাধিস্থলের পাশেও বসে থাকতে দেখেন পড়শিরা। তবে আপাতত পুরনো পড়শির পাশেই রয়েছে সাহেববাগানের বাসিন্দারা। রাতে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা রূপসী চট্টোপাধ্যায়, পিন্টু ঘোষালরা বলেন, “সাধ্যমতো উমাদেবীর পাশে থাকার চেষ্টা করছি। ওঁনার যাতে খাওয়ার কোনও অসুবিধা না হয়, তার দায়িত্ব আমরা ভাগ করে নিয়েছি।”
ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন নি? চন্দন রায় বলে এক বাসিন্দার দাবি, “উমা দেবীকে আমি পিসিমণি বলে ডাকি। পিসিমণির ছেলের ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল। ওকে ফোন করে পিসিমণিকে নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু ও অস্বীকার করে। পুলিশে জানানোর কথা বললেন রাহুল জানায়, সে অপারগ। বাধ্য করলে সে আত্মহত্যা করবে।” রাত পর্যন্ত বারবার চেষ্টা করা হলেও রাহুলের ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যায়নি।
কাটোয়ার সাহেবতলার বাসিন্দাদের এখন একটাই চাওয়া, উমাদেবী ভবঘুরে জীবন থেকে মুক্তি পান। কোনও বৃদ্ধাশ্রম বা সরকারি হোমে ঠাঁই হোক তাঁর। খবর পেয়ে রাতের দিকে বর্ধমান পুলিশ নিয়েও যায় উমাদেবীকে।
আর ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন নি কেন জানতে চাইলে, আঁচলের কোনায় চোখের জল মুছে উমাদেবীর জবাব, “মা হয়ে কী ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যায়।”