পানাগড়

জাতীয় সড়কের যানজটেই নাভিশ্বাস শহরের

পানাগড় মানেই জাতীয় সড়কের ফাঁস, রেলগেটে যানজট, বেহাল নিকাশি। আবার সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের সেরা সেনা ছাউনি, গাড়ির যন্ত্রাংশের অন্যতম বড় বাজারও পানাগড়। আবার কারও কাছে পানাগড় মানেই দানবাবার মেলা। সবমিলিয়ে, আর পাঁচটা জনপদের মতো ঘাত-প্রতিঘাত, আলো-আধাঁর সঙ্গে নিয়েই পথে চলা এ শহরের।

Advertisement

সুব্রত সীট

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:৪৮
Share:

যানজটে হাঁসফাঁস পানাগড় বাজার। ছবি : বিশ্বনাথ মশান।

পানাগড় মানেই জাতীয় সড়কের ফাঁস, রেলগেটে যানজট, বেহাল নিকাশি। আবার সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের সেরা সেনা ছাউনি, গাড়ির যন্ত্রাংশের অন্যতম বড় বাজারও পানাগড়। আবার কারও কাছে পানাগড় মানেই দানবাবার মেলা। সবমিলিয়ে, আর পাঁচটা জনপদের মতো ঘাত-প্রতিঘাত, আলো-আধাঁর সঙ্গে নিয়েই পথে চলা এ শহরের।

Advertisement

কলকাতা থেকে প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার দূরে আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের প্রবেশ দ্বার এ জনপদের বয়স দেড়শো পেরিয়েছে। ১৮৬৭ সালে যখন নতুন মহকুমা হিসেবে রানিগঞ্জ গড়ে ওঠে তার মধ্যে একটি থানা ছিল কাঁকসা। পানাগড় এই কাঁকসা থানারই অন্তর্গত। তবে বহিরঙ্গে কাঁকসা ও পানাগড়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া ভার। এরা যেন একে অপরের পরিপূরক। থানা, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, স্কুল, বাজার সব ভাগ করে নিয়েছে তারা। বিভিন্ন প্রয়োজনে বাসিন্দাদের দু’জায়গাতেই অনবরত যাতায়াত লেগে থাকে। তবে কাঁকসায় এখনও শহুরে হাওয়া ততটা ঢোকেনি যতটা ঢুকেছে পানাগড়ে।

শহরের পুরনো বাসিন্দারাই জানান, দিন দিন ঘরবাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিকাশি সমস্যা, পানীয় জলের আকাল। পাড়ার ভিতরের রাস্তাঘাটও অপরিসর। পানগড়ের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেও দেখা গিয়েছে, গায়ে গায়ে বাড়ি উঠেছে। মাঝে ফাঁকা জায়গা নেই। ফলে হঠাৎ বিপদ-আপদ হলে গাড়ি বা অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার রাস্তা মেলাই ভার। এমনকী অগ্নিকাণ্ড বাধলে দমকলের গাড়ি ঢুকতেও কালঘাম ছুটে যাওয়ার দশা। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, পানাগড় চরিত্রে না গ্রাম না শহর। ফলে নির্মাণ নিয়ে শহরের মতো নিয়মের কড়াকড়ি বা নজরদারি কোনওটাই নেই। অথচ এখানে যাঁরা বাইরে থেকে বসবাস করতে আসছেন তাঁরা আর্থিক ভাবে বেশ স্বচ্ছল। ফলে এসেই বড় বড় বাড়ি তৈরি করে ফেলছেন তাঁদের অনেকে। পরিকল্পনার অভাবে দিন দিন সমস্যা আরও বাড়ছে। এ ছাড়া ২ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’পাশ জুড়ে পানাগড় বাজার। যানবাহনের ভিড় এড়িয়ে বাজার করাও একপ্রকার বিভীষিকা। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, “বাজারের থলি হাতে নয়, মনে হয় প্রাণ হাতে বাজারে এসেছি।” পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির পানাগড়ে নগরায়ণের কোনও সুষ্ঠ পরিকল্পনা নেই বলেও তাঁদের অভিযোগ।

Advertisement

তবে যানজট বোধহয় সবচেয়ে বড় সমস্যা এ শহরের। জাতীয় সড়কের দার্জিংলিং মোড় থেকে পানাগড় বাজার পেরিয়ে পড়ে রেল ওভারব্রিজ। সওয়া তিন কিলোমিটার এই রাস্তা চার লেনের না হওয়ায় রাস্তা পেরোতেই লেগে যায় দীর্ঘ সময়। স্বর্ণ চতুষ্টয় জাতীয় সড়ক প্রকল্পে পানাগড় থেকে ডানকুনি এবং পানাগড় থেকে বরাকর পর্যন্ত চার লেনের সড়ক নির্মাণের কাজ জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ শেষ করেন নির্দিষ্ট সময়েই। কিন্তু পানাগড়ে এসে তা থমকে যায়। আপত্তি ওঠে নানা মহলে। এক দিকে, রাস্তা সম্প্রসারণ করতে গেলে দোকান-বাজার, বাড়ি ভাঙা পড়বে। আবার বাইপাস নির্মাণ হলে মার খাবে পানাগড়ের বিশাল বাজার। স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির হিসাবে যেখানে লেনদেনের পরিমাণ মোটেও বছরে ১০০ কোটির কম নয়। ফলে জট আরও জটিল হয়। এ ছাড়া পানাগড়ের দার্জিলিং মোড়ে এসে যোগ হয়েছে পানাগড়-মোড়গ্রাম রাজ্য সড়ক। সব মিলিয়ে জাতীয় সড়কের এই অংশে দিনভর যানজট লেগেই থাকে। নানা কারণে রাস্তা পারাপার করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। দুর্ঘটনায় গড়ে বছরে ১০ জনেরও বেশি মারা যান। তবে অনেক টালবাহানার পরে মাস ছয়েক আগে বাইপাস নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এটাই যা স্বস্তি বাসিন্দাদের।

পানাগড়ের মাঝামাঝি দিয়ে গিয়েছে সদাব্যস্ত কলকাতা-দিল্লি রেল লাইনও। ফলে সারাদিন ধরেই রাজধানী এক্সপ্রেস, শতাব্দী এক্সপ্রেস থেকে শুরু করে অজস্র মেল, এক্সপ্রেস, সুপার ফাস্ট ট্রেন এবং পুরুলিয়া ও আসানসোল থেকে বর্ধমান রুটের বহু লোকাল ট্রেন চলে। ফলে দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে পানাগড় পশ্চিম কেবিন লাগোয়া রেলগেটটি। যানজট লেগে থাকে রেললাইনের উপর দিয়ে যাওয়া পানাগড়-সিলামপুর রোডে। রেললাইনের একদিকে পানাগড়, কাঁকসা। অন্যদিকে রণডিহা, সিলামপুর, ভরতপুর প্রভৃতি গ্রাম। পানাগড় ও কাঁকসায় রয়েছে একাধিক ব্যাঙ্ক, স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, থানা, বিডিও অফিস, দমকল, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বেসরকারি হাসপাতাল। অন্যদিকে রেললাইনের ওপারে রণডিহায় রয়েছে সেচ দফতরের কার্যালয়, সেচ দফতরের বাংলো। হাইস্কুল, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, ব্যাঙ্ক, বাজার রয়েছে সিলামপুর, ভরতপুরে। আবার পানাগড় এলাকার প্রধান বাজার। ফলে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে নিয়মিত রেল লাইন পারাপার করতে হয় দু’পারের মানুষকে। দিনের অধিকাংশ সময় রেলগেট বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন তাঁরা। ফলে অনেকে বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে রেলগেট বন্ধ থাকলেও রেললাইন পারাপার করেন তাঁরা। এভাবে যাতায়াত করতে গিয়েই ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায় কাঁকসা হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুমনা সিংহ (১৭)। আরও চার সহপাঠীর সঙ্গে পানাগড়ে প্রাইভেট টিউশন পড়তে যাওয়ার সময় রেলগেট পড়ে থাকা সত্বেও ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পেরোতে গিয়েছিল সুমনা। কুয়াশার মধ্যে ছুটে আসা হাওড়াগামী অগ্নিবীনা এক্সপ্রেসে কাটা পড়ে সে। তাছাড়া রেললাইনের দক্ষিণে কোনও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে দমকলের গাড়িও আটকে যায় রেলগেটে।

পানাগড়বাসীর আক্ষেপ, এলাকায় একটি সরকারি ডিগ্রি কলেজ হল না আজও। শিশু-শিক্ষাকেন্দ্র, প্রাথমিক স্কুল, হাইস্কুল, উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল-সব আছে। এমনকী বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ে উঠেছে পানাগড়ে। কিন্তু সরকারি ডিগ্রি কলেজ নেই। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে পড়ুয়াদের ছুটতে হয়, দুর্গাপুর, মানকর, গলসি বা বর্ধমান। কেউ কেউ আবার বোলপুরেও যায়। যাতায়াতের সমস্যার কারণে অনেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দা কাঁকসা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায় বা পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ রচিন মজুমদার, দু’জনেরই বক্তব্য, “এলাকায় একটি ডিগ্রি কলেজ গড়ে উঠলে বিশেষ করে আর্থিক ভাবে অনগ্রসর পড়ুয়ারা বিশেষ ভাবে উপকৃত হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন