দরজা ভাঙা, তবু চলছে বাস।—নিজস্ব চিত্র।
দিনে অটোর বাঁধনছাড়া ভাড়া আর রাতে বাসের আকাল-- দুইয়ে মিলে জেরবার দুর্গাপুরবাসী। সকালে স্কুল-কলেজ, অফিস যাওয়ার পথে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় তো বটেই, একটু বেশি রাতে শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা যেতেও নাজেহাল হয়ে যান বাসিন্দারা। শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার হাল দেখে তাঁদের এখন একটাই প্রশ্ন, এ সমস্যা মিটবে কবে? মহকুমা পরিবহণ দফতর এবং বিভিন্ন বাস মালিক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে অবশ্য ইতিবাচক ইঙ্গিতই মিলেছে।
মিনিবাস নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ নতুন নয়। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে রাত নামলেই বেমালুম হাওয়া হয়ে যাওয়া নিয়ে বাসিন্দারা একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েছেন। উল্টো দিকে মিনি বাস মালিকেরাও জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের দাম, যন্ত্রাংশের দাম, কর্মীদের বেতন বাড়লেও বাস ভাড়া বাড়াতে পারেন নি তাঁরা। ফলে বহু বাস উঠে গিয়েছে। যেগুলি চলছে সেগুলিও উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নড়বড়ে। তবে সম্প্রতি ভাড়া সামান্য বেড়েছে। এর ফলে পরিস্থিতি বদলাবে কি না জানতে চাওয়া হলে আশার কথা শুনিয়েছেন দুর্গাপুরের বাস মালিকদের অন্যতম সংগঠন ‘দুর্গাপুর প্যাসেঞ্জার ক্যারিয়ারস অ্যাসোসিয়েশন’-র সাধারণ সম্পাদক কাজল দে। তিনি বলেন, “ইতিমধ্যেই বসে যাওয়া বাসগুলি চালু করার উদ্যোগ হয়েছে। পয়লা নভেম্বর থেকে বেশ কিছু বাস আবার চলবে। ফলে রাতের দিকে বাসের সংখ্যা বাড়বে।” তবে ‘দুর্গাপুর মিনিবাস অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের’ সভাপতি অলোক চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, শুধু ভাড়া বাড়ালেই হবে না। বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে মিনিবাস পরিষেবা টিকিয়ে রাখা মুশকিল। তিনি বলেন, “মিনিবাসের রুটে অটো চলছে। ফলে বাসের যাত্রী মিলছে না। বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ভাড়া বাড়লেও সমস্যা মিটবে না।”
বেআইনি অটোর রমরমার বিরোধীতা করছেন শহরের পুরনো অটোচালকেরাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রবীণ অটোচালক বলেন, “মিনিবাসের থেকেও আমাদের উপরে বেশি ভরসা ছিল মানুষের। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি সবাই আমাদের অন্য নজরে দেখেন। বেআইনি অটোর রমরমায় আমরা যাঁরা রুটে অটো চালাই তাঁদেরও নাভিশ্বাস দশা!” মহকুমা পরিবহণ দফতরও স্বীকার করে নিয়েছে, যে বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়, আইনি পদক্ষেপ করা হয় ঠিকই তবে ‘রুটিন চেকিং’ ছাড়া টানা অভিযান চালানোর মতো পরিকাঠামো দফতরের হাতে আপাতত নেই। তবে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে প্রশাসন? জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, দুর্গাপুরে অন্তত শ’দেড়েক অটো চলছে পারমিট ছাড়া। এক একজনের নামে একাধিক অটো এবং রুটের অনুমোদনও রয়েছে। অথচ গত ২ এপ্রিল হাইকোর্ট স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, একজনের নামে একটি রুটেরই অনুমোদন দেওয়া যাবে। জেলা পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, একাধিক রুটের অনুমোদন রয়েছে এমন ৮০ জন অটোচালককে চিহ্নিত করে শুনানিতে হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তবে অনেকেই শুনানিতে আসেননি। ফের এক দফা নোটিস পাঠানো হবে। এরপরেও না এলে ওই অটো মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দফতরের এক আধিকারিক।
তবে বাস-অটো সমস্যার সুরাহার আশ্বাস মিললেও শহরে এই মুহূর্তে প্রি-পেড ট্যাক্সি চালুর কোনও সম্ভাবনা নেই বলে জানা গিয়েছে। মেয়র তথা বিধায়ক অপূর্ব মুখোপাধ্যায়ের মতে, মিনিবাস ও অটোর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ট্যাক্সির চাহিদা আগের মতো নেই। তিনি বলেন, “ট্যাক্সি চালকদের দুর্দশার কথা জানি। তবে প্রি-পেড ট্যাক্সি চালু হলেই যে ট্যাক্সির চল বেড়ে যাবে এমন মনে হয় না। তবে ট্যাক্সি চালক এবং সাধারণ যাত্রী, দু’দিকের কথা ভেবে কি করা যায় দেখছি।”
১৯৬৩ সালে দুর্গাপুর রাজ্য পরিবহণ সংস্থা হিসাবে জন্ম নিয়েছিল আজকের দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহণ সংস্থা। সেই সময় দুর্গাপুর শিল্প শহরের গণ পরিবহন ব্যবস্থার ভিত গড়েছিল এই সংস্থাই। তার অনেক পরে চালু হয় বেসরকারি মিনিবাস পরিষেবা। বছর পাঁচেক আগে চালু হয় অটো। কিন্তু আজকের দুর্গাপুরের জন্য যে তা পর্যাপ্ত নয়, তা পদে পদে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কি ভাবছে দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহণ সংস্থা? সংস্থার চেয়ারম্যান তমোনাশ ঘোষ বলেন, “দুর্গাপুর শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ছোট সরকারি বাস চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।” সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বাসগুলিতে ২৮ টি করে আসন থাকবে। ফলে বড় বাসের মতো প্রচুর যাত্রীর প্রয়োজন হবে না। ফাঁকা আসন নিয়ে বাস চালিয়ে লোকসান বাড়ার সম্ভাবনাও কম। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর নবকুমার বর্মণ বলেন, “রাত নামলে বাস মেলে না বলে অভিযোগ রয়েছে শহরবাসীর। তাই প্রথমে রাতের দিকে কিছু বাস চালানোর কথা ভাবা হয়েছে।” তবে কবে থেকে পরিষেবা চালু হবে তা জানাতে পারেননি তিনি। তিনি বলেন, “নতুন বাস এলেই পরিষেবা চালু করা হবে।”