নথি ছাড়াই বাজারে দেদার বিকোচ্ছে অ্যাসিড

দেশের বিভিন্ন অংশে মহিলাদের উপরে অ্যাসিড হানার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই অ্যাসিড বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু তার পরেও অ্যাসিড-হামলার ঘটনা ঘটছেই।

Advertisement

সুব্রত সীট ও সুশান্ত বণিক

দুর্গাপুর ও আসানসোল শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৪ ০০:১১
Share:

দেশের বিভিন্ন অংশে মহিলাদের উপরে অ্যাসিড হানার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই অ্যাসিড বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু তার পরেও অ্যাসিড-হামলার ঘটনা ঘটছেই। মঙ্গলবার রাতে আসানসোলের চিত্তরঞ্জন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রানাঘাটের এক মহিলার উপরে অ্যাসিড আক্রমণ আরও একবার প্রমাণ করল খাতায় কলমে আইন থাকলেও তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চোরাগোপ্তা এবং কোথাও কোথাও রীতিমত প্রকাশ্যে অ্যাসিড বিক্রি চলছেই।

Advertisement

মঙ্গলবার রাতে আসানসোলের চিত্তরঞ্জন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রানাঘাটের ওই মহিলার উপরে অ্যাসিড আক্রমণ করেন তাঁরই পড়শি রিপন দাস। সেই মহিলা এখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি (আরআইও)-তে ভর্তি রয়েছেন। কিন্তু রানাঘাটের ওই হতভাগ্য মহিলার মতো যদি আরও কেউ অ্যাসিড-হামলার শিকার হন? আতঙ্কের চোরা স্রোত বইছে গোটা জেলা জুড়ে।

কী বলছে প্রশাসন? আসানসোলের মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস জানিয়েছেন, গত বছরের অগস্ট মাস থেকেই অ্যাসিড বিক্রির উপরে কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে। তবে নির্বাচনের জন্য মাঝে কয়েক মাস সেই নজরদারিতে ভাটা পড়েছে। তিনি বলেন, “আবার জোরদার অভিযান শুরু করা হবে।” দুর্গাপুরের মহকুমাশাসক কস্তুরী সেনগুপ্ত কড়া নজরদারির পাশাপাশি অভিযুক্তদের কঠোর সাজার পক্ষে সওয়াল করেছেন। তিনি বলেন, “এই ভয়াবহ প্রবণতা দূর করার জন্য সার্বিক ভাবে লড়তে হবে। অভিযুক্তদের দ্রুত কড়া সাজা দিতে হবে।” তিনি জানান, এই বিষয়ে প্রশাসনিক নজরদারি রয়েছে। সেটা আরও জোরদার করা হবে।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, সচিত্র পরিচয়পত্র ও অ্যাসিড কেনার প্রয়োজন লিপিবদ্ধ করার পরেই অ্যাসিড বিক্রি করা যাবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কী ভাবে সাধারণের হাতে অতি সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে এই গরল তরল? খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, আসানসোল ও দুর্গাপুরের বহু হার্ডওয়্যারের দোকানেই কিনতে পাওয়া যায় এটি। এ ছাড়া গোপনেও বিক্রি হয় অনেক জায়গায়।

বৃহস্পতিবার আসানসোল ও দুর্গাপুরের বিভিন্ন হার্ডওয়্যারের দোকানে গিয়ে দেখা গিয়েছে, কাচের বোতলে দেদার বিক্রি হচ্ছে অ্যাসিড। একজন দোকান মালিক জানালেন, সোনার দোকানের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত মূলত তাঁরাই অ্যাসিড কেনেন। কুলটির কেন্দুয়া এলাকায় প্রত্যন্ত বস্তিতে বাতিল ব্যাটারি থেকে নতুন ব্যাটারি গড়ে তোলার কারখানা চালান মহম্মদ জামা ফারুকি। তিনি জানান, ব্যাটারি তৈরির জন্য প্রয়োজন হল খাঁটি সালফিউরিক অ্যাসিড। তিনি বলেন, “আসানসোল বাজার থেকে অ্যাসিড কেনার সময় পরিচয়পত্র, অ্যাসিড কী কাজে লাগবে সেগুলো কখনই জানতে চাওয়া হয় না।” আসানসোলের রাহা লেন ঘাঁটি গলি এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী বেনীপ্রসাদ আচার্য জানান, সোনার কারবারে গয়না পালিশ করার জন্য সালফিউরিক অ্যাসিড ও কাঁচা সোনাকে পাকা করার কাজে নাইট্রিক অ্যাসিড লাগে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জানালেন, আসানসোল বাজারে এই অ্যাসিডগুলি অত্যন্ত সহজলভ্য। দুর্গাপুর স্টেশন বাজার এলাকায় অলঙ্কার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এক কারিগর বলেন, “একটি সোনার দোকানের পরিচিত এক কর্মী আমাকে ঘুরপথে অ্যাসিড এনে দেন।” বেনাচিতির স্বর্ণ ব্যবসায়ী চন্দন দাস বলেন, “কলকাতার এক সংস্থা সরাসরি অ্যাসিড দিয়ে যায়।” তবে তাঁর দাবি, “আমাদের দোকান থেকে অ্যাসিড বাইরে বেরোনোর কোনও সুযোগ নেই।”

অ্যাসিডের নিয়মিত ব্যবহার হয় স্কুল-কলেজের গবেষণাগারে। দুর্গাপুর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষা মধুমিতা জাজোরিয়া জানান, অ্যাসিড কেনার পরে তা সরাসরি কলেজের স্টোরে ঢুকে যায়। তিনি বলেন, “সব জায়গাতেই ‘রেকর্ড’ রাখার ব্যবস্থা আছে। কোনও ভাবেই বাইরে অ্যাসিড বেরোনোর সুযোগ নেই।” বিধাননগরের ফুলঝোড়ের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের চেয়ারম্যান দুলাল মিত্র জানান, যে সব সরকারি সংস্থার কাছ থেকে তাঁদের কলেজ অনুমোদন পেয়েছে তারা এই বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি চালায়। এ ছাড়াও কলেজের পক্ষ থেকেও হিসেব রাখা হয়। রানিগঞ্জের টিডিবি কলেজের অধ্যক্ষ নৃপঙ্কর হাজরা জানালেন, তাঁরা ইউজিসি অনুমোদিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজন মতো অ্যাসিড কেনেন। অ্যাসিড ব্যবহারের হিসেব রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী আছেন।

বিভিন্ন হাসপাতালেও হয় অ্যাসিডের ব্যবহার। আসানসোল জেলা হাসপাতালের সুপার নিখিল দাস বলেন, “আমাদের হাসপাতালে অ্যাসিডের ব্যবহার খুব কম। প্রয়োজন হলে পরিমাণ মতো বাজার থেকে কিনে নেওয়া হয়।” অন্য দিকে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের সুপার দেবব্রত দাস বলেন, “হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন করার কাজে কম ঘনত্বের হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড লাগে। তবে তার প্রভাব তেমন মারাত্মক নয়। স্টোর থেকে হিসেব রেখেই অ্যাসিড দেওয়া হয়। কাজেই তা বাইরে বেরোনোর প্রশ্নই নেই।”

সরকারি আশ্বাসেও শিল্পাঞ্চলের আতঙ্ক কিন্তু কাটছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন