পুরসভার ভিতরে তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
শূন্যে হাত ছুড়ে স্লোগান দিচ্ছে শ’খানেক লোক। বাজনা বাজছে তারস্বরে। চলছে বাজি পোড়ানো, মিষ্টিমুখ, আবির খেলাও। সোমবার দুপুরে আসানসোল পুরসভার সামনে দলীয় পতাকা হাতে তৃণমূলের কিছু কর্মীর এই উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয়, তাঁদের দল বোধহয় কোনও ভোটে জিতেছে।
এ দিন ওই তৃণমূল সমর্থকদের বাজি পোড়ানো, আবির খেলার কারণ, আসানসোলের সদ্য প্রাক্তন মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরসভার অন্যতম প্রশাসক হিসেবে কাজে যোগদান। তাঁর একটি প্রশাসনিক পদে বসাকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের একাংশের এই উচ্ছ্বাস দেখে বিরোধী নেতাদের মন্তব্য, “পুরসভা যেন নিজেদের দলের কার্যালয় করে নিয়েছে ওরা।” গোটা ঘটনা শোনার পরে তৃণমূলেরই আসানসোলের এক নেতা বলছেন, “দলের এক জনের প্রশাসনিক পদে বসা নিয়ে কয়েক জনের এই রকম কাণ্ডকারখানা দলের ভাবমূর্তিই খারাপ করবে।”
বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন রবিবার জানান, আসানসোল পুরসভায় দুই সদস্যের প্রশাসক বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলাশাসক (আসানসোল) সুমিত গুপ্তকে। তাপসবাবুকে অন্যতম সদস্য হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। পুরসভার যে কোনও সিদ্ধান্ত তাঁরা দু’জন নেবেন। এই সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। এই খবর সামনে আসার পরেই সদ্য প্রাক্তন মেয়র কী ভাবে প্রশাসনিক পদে বসেন, সে প্রশ্ন তোলে বিরোধীরা। দলতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করছে বর্তমান রাজ্য সরকার, এই অভিযোগ তুলে তারা সরব হয়।
সোমবার দায়িত্ব নেন তাপসবাবু। তিনি ঠিক কী দায়িত্ব পালন করবেন, সে প্রশ্নে তাপসবাবু বলেন, “আমাকে সরকার এই পদে বসিয়েছে। আমার কী দায়িত্ব তা নির্দিষ্ট করে দেয়নি। বোর্ডে এক জন আইএএস পদমর্যাদার অফিসার চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন। তাঁকে কাজে সাহায্য করব।” আসানসোলে তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ডের মেয়াদ ফুরিয়েছে মাস কয়েক আগে। কিন্তু, রাজ্যের বেশ কয়েকটি পুরসভার মতো এখানেও এখনও ভোট হয়নি। পুরসভা এলাকায় নাগরিক পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে নিয়মানুযায়ী এক জন প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। গত ১৭ জুলাই প্রশাসকের দায়িত্ব নেন তৎকালীন অতিরিক্ত জেলাশাসক অমিত দত্ত। তিনি বদলি হওয়ার পরে এই পদে বসেন বর্তমান অতিরিক্ত জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত।
পুরসভা চত্বরে তৃণমূল কর্মীদের ভিড়।
মাস তিনেকের মাথায় হঠাৎ প্রাক্তন মেয়রকে প্রশাসক বোর্ডের সদস্য করা হল কেন, সে প্রসঙ্গে প্রশাসনের এক কর্তা এ দিন দাবি করেন, পুরসভার কিছু কাজে অস্বচ্ছতা ধরা পড়েছে। প্রশাসক নিয়োগের পরে এ সব বিষয়ে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা হওয়ায় কিছু আপত্তি উঠতে শুরু করে। তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতেই এক জন সরকারি আধিকারিকের পাশে প্রাক্তন মেয়রকে প্রশাসক-সদস্য করে বসানো হল। তবে এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ পুরসভার প্রশাসক সুমিত গুপ্ত। তিনি বলেন, “তাপসবাবু অভিজ্ঞ ব্যক্তি। পুরসভায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। মানুষের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। আমরা এক সঙ্গে কাজ করব।” তাপসবাবুও বলেন, “মানুষের সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগ রেখে পরিষেবা দেওয়ার কাজে প্রশাসককে সাহায্য করতে পারব। তাই সরকার আমাকে এই পদে বসিয়েছে।”
এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ তাপসবাবু পুরসভায় ঢোকার আগে থেকেই পুরসভা চত্বরে বাজনাদারদের নিয়ে হাজির হয়ে যায় কিছু তৃণমূলের কর্মী। তাপসবাবু ঢুকতেই উল্লাস শুরু হয়ে যায়। পুরসভার সিইও-র কক্ষটি তাপসবাবুর জন্য বরাদ্দ রয়েছে। তিনি সেখানে গিয়ে বসার পরে দলীয় কর্মীরা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাঁর দায়িত্বে বসা নিয়ে দলের কর্মী-সদস্যদের এই তৎপরতার কারণ কী? তাপসবাবু বলেন, “আমি এতে অন্যায় দেখছি না। আমি তো এই দল করি। যাঁরা আমায় ভালবাসেন, তাঁরা আবেগের বশে এই ভাবে এসেছেন।”
তবে ঘটনার সমালোচনা করেছে বিরোধীরা। প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিএম নেতা তাপস রায় বলেন, “ওঁরা তো পুরসভাকে দলীয় কার্যালয় করে দিল।” আসানসোলের কংগ্রেস নেতা তথা দলের প্রদেশ সম্পাদক আকাশ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “একে তো অগণতান্ত্রিক ভাবে পদে বসানো হয়েছে প্রাক্তন মেয়রকে। তার উপের এ ভাবে পুরসভা চত্বরে উল্লাসের নিন্দার কোনও ভাষা নেই।” বিজেপি-র আসানসোল জেলা সম্পাদক প্রশান্ত চক্রবর্তী বলেন, “আমরা এই বেনিয়মের বিরোধিতায় নামব।”