বহুতল বাড়ছে কাটোয়া শহরে।
চেহারা রয়ে গিয়েছে একই। কিন্তু জমির দাম বেড়েই চলেছে কাটোয়া শহরে।
ছোট এই শহরে আধুনিক জীবনযাত্রার পরিকাঠামো সে ভাবে গড়ে ওঠেনি এখনও। রাস্তায় এখনও যাতায়াত করে গরুর গাড়ির। রিকশার বাড়বাড়ন্ত ও দৌরাত্ম্যে মানুষ তিতিবিরক্ত। রাতবিরেতে চিকিৎসা পাওয়া কার্যত লটারি জেতার সামিল বলে মনে করেন শহরবাসী। এত ‘নেই’য়ের পরেও কাটোয়া শহরে বেড়ে চলছে বাসিন্দার সংখ্যা।
মাত্র ৭.৯৩ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে এই শহর। জনসংখ্যা ৮৮ হাজারের আশপাশে। অর্থাৎ, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১ হাজারের বেশি মানুষের বাস। অথচ, এই গ্রামীণ বর্ধমানের জেলা সদরে জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে সাড়ে ছ’হাজারের কাছাকাছি। কাটোয়ার পাশের শহর নবদ্বীপে তা ১০১২২। তুলনামূলক ভাবে কাটোয়া শহরে জনঘনত্ব অন্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি।
এখন প্রশ্ন, এই শহরে ভিড় বাড়ছে কেন?
কাটোয়া শহরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। অজয়-ভাগীরথী তীর বরাবর ‘পুরনো কাটোয়া’। টেলিফোন ময়দান-সার্কাস ময়দান-সুবোধ স্মৃতি রোড ঘিরে ‘মধ্য কাটোয়া’। আর এসটিকেকে রোড, বর্ধমান-কাটোয়া রোডের দু’পাশে গজিয়ে ওঠা জনপদ ঘিরে ‘নতুন কাটোয়া’। কাটোয়া থেকে খুব কাছে রয়েছে তিন জেলার সীমানামুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও বীরভূম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘মধ্য কাটোয়া’ এলাকায় অধিকাংশ বাসিন্দার আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদের সালার, শক্তিপুর, ভরতপুর, বড়ঞা এলাকায়। তাঁরা আটের দশকে কাটোয়া শহরে জায়গা কিনে রেখেছিলেন। পরে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন। ভরতপুরের আলুগ্রামের শিক্ষক পীযূষ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “আমাদের এলাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ খারাপ। সেখানে কাটোয়া নানা জায়গার যোগাযোগ অনেক উন্নত। আমাদের এলাকা থেকে এখানে এসে বাস করার নানা কারণের মধ্যে এটি অন্যতম।” এ বছর তাঁর ছেলে রক্তিম কাটোয়ার কাশীরাম দাস বিদ্যায়তন থেকে পড়াশুনো করে জয়েন্ট এন্ট্রাসে মেডিক্যালে ২০তম স্থান পেয়েছে।
মুর্শিদাবাদের টেঁয়া গ্রামের কালোসোনা বৈরাগ্য নিয়মিত কাটোয়ায় আসেন। তাঁর মেয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে এ বছরই কাছারি রোডে ফিজিওথেরাপি সেন্টার করেছেন। কালোসোনাবাবুর কথায়, “শুধু চিকিৎসার জন্যই চারটি জেলা থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ কাটোয়া আসেন।” তাঁর মতে, কাটোয়া-আজিমগঞ্জ লাইনের টেঁয়া স্টেশন পর্যন্ত এলাকার বড় অংশের মানুষ কাটোয়ার উপরে নির্ভরশীল। তেমনই নদিয়ার নাকাশিপাড়া-কালীগঞ্জ এলাকার ভাগীরথী পাড় ঘেঁষা গ্রামের মানুষদের বড় ভরসাও এই শহর। সেখান থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ রুজির জন্য এই শহরে আসেন। ভাগীরথীর তীরে দাঁড়ালে প্রতি দিনই দেখা যায়, নৌকা বোঝাই করে মুদিদ্রব্য নদিয়ার প্রান্তে যাচ্ছে। এক মাঝি বলছিলেন, “মাটিয়ারি থেকে কাঁসা-পিতলের বাসন এনে শহরের দোকানে সরবরাহ করি। ফিরতি পথে মুদিখানার জিনিস নিয়ে এলাকায় ফিরে যাই।”
আটের দশকে কাটোয়া স্টেডিয়ামকে ঘিরে আবাসন গড়ে ওঠে। মূলত কাটোয়ার পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দারা আবাসন এলাকায় বাড়ি কিনে বাস শুরু করেন। তা দেখে আশপাশে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠতে থাকে জনবসতি। শহর জুড়ে রাস্তা-আলো-জলের পরিষেবায় সমস্যা না থাকায় বসবাসে কোনও সমস্যাও হচ্ছে না। মানুষজন বাস করছেন শান্তিতেই।
তবে এরই মাঝে গত কয়েক বছরে কাটোয়া শহরে জমির দাম বেড়ে গিয়েছে হুহু করে। শহরবাসীর কাছে বড় প্রশ্ন, এখানে জমির দাম গত কয়েক বছরে ৭-৮ গুণ বাড়ার কারণ কী? কাছারিপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা পাঁচুগোপাল বক্সীর মতে, “ভৌগলিক দিক দিয়ে কাটোয়া শহরের তিন দিক ভাগীরথী-অজয় দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ দিক শুধু মাত্র খোলা। স্বাভাবিক ভাবেই জমির পরিমাণ কম। সে জন্যই এখানে জমির দাম আকাশছোঁয়া।” বছর দু’য়েক আগেও শহরে নদীর পাশে প্রতি কাঠা যে জমির দাম ৫০ হাজার টাকা ছিল, তা এখন ৪ লক্ষ টাকা। বসবাসের উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই, এমন জায়গাই চার থেকে ছ’লক্ষ টাকায় নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে। সার্কাস ময়দান, টেলিফোন ময়দান, সুবোধ স্মৃতি রোড এলাকায় যেটুকু জায়গা পড়ে আছে, তার দাম গড়ে ১৫-২০ লক্ষ টাকা। শোনা যায়, ওই সব এলাকায় কাঠা প্রতি ২৮ লক্ষ টাকা দামেও জমি বিক্রি হয়েছে। কাটোয়া মহকুমা প্রশাসনের অফিসের কর্মী মানিক মুখোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, “জোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি। তাই জমির দাম বাড়ছে।”
এই দাম বাড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দালাল চক্র। অভিযোগ, জমি বিক্রি করলে ভাল দাম পাইয়ে দেবে বলে জমিমালিকদের জেরবার করে দেয় তারা। এক জমিমালিকের কথায়, “দালালেরা বাড়িতে এসে তো বটেই, ফোন করেও জ্বালাচ্ছে। আমার কথা বিশ্বাস না করে বন্ধু-বান্ধবদের দিয়েও খোঁজ নিচ্ছে। মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়!” শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী থেকে চা-সব্জি-মাছ বিক্রেতাএই চক্রে সকলেই রয়েছেন বলে দাবি জমিমালিকদের। মালিকের জমি বিক্রি করবেন না জানালেও দমে যান না তাঁরা। দাম চড়িয়ে প্রস্তাব দিয়ে যেতে থাকেন। এলাকা সূত্রে জানা যায়, অনেক সময়ে কয়েক জন দালাল মিলে মালিকদের কাছে জমি কিনছেন। তার পরে বিক্রি করছেন সুযোগ বুঝে। জমির দাম তাই বেড়েই চলছে কাটোয়া।
(চলবে)