ভাল রেস্তোঁরা, সিনেমা হল চায় কাটোয়া

শহরে ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শহুরে জীবনের নানা প্রয়োজন। মান্ধাতা আমলের পরিষেবাকে পিছনে ফেলে আধুনিক সুযোগ সুবিধা চাইছেন মানুষ। ঘুরেফিরে উঠছে একটাই অমোঘ প্রশ্ন, যানজট, রিকশার দৌরাত্ম্য, ফুটপাথ দখল, বেহাল নিকাশি পেরিয়ে কত দিনে উত্তরণ হবে এ শহরের?

Advertisement

সৌমেন দত্ত

কাটোয়া শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৪ ০১:৪৭
Share:

সৌন্দর্য্যায়নের অপেক্ষায় অজয়-ভাগীরথীর সঙ্গমস্থল।

শহরে ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শহুরে জীবনের নানা প্রয়োজন। মান্ধাতা আমলের পরিষেবাকে পিছনে ফেলে আধুনিক সুযোগ সুবিধা চাইছেন মানুষ। ঘুরেফিরে উঠছে একটাই অমোঘ প্রশ্ন, যানজট, রিকশার দৌরাত্ম্য, ফুটপাথ দখল, বেহাল নিকাশি পেরিয়ে কত দিনে উত্তরণ হবে এ শহরের?

Advertisement

একটি সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমের নির্বাহী প্রযোজক অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায়ের ছোটবেলা কেটেছে এ শহরের হরগৌরি পাড়ায়। এখন মাঝে মধ্যে কাটোয়া এলে সময় কাটতে চায় না তাঁর। অর্ঘ্যবাবু বলেন, “সব বন্ধুরা যে একসঙ্গে হই হই করে আড্ডা মারব, সে জায়গায় নেই। অথচ অজয়-ভাগীরথী পাড়কে কাজে লাগিয়ে কত ভাল সৌন্দর্য্যায়ন করা যেত।”

কাটোয়া শহরের গৌরাঙ্গপাড়ার বাসিন্দা পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় থাকেন বোকারোতে। প্রায় দিনই গাড়ি নিয়ে কাটোয়া চলে আসেন তিনি। তাঁর কথায়, “শহরে একটা ভাল রেঁস্তোরা নেই যেখানে নিরিবিলিতে বসে খাওয়া যায়।” সম্প্রতি পুণে থেকে বদলি হয়ে কাটোয়া শহরে এসেছেন এক ব্যাঙ্কের কর্মী। কাটোয়া শহর নিয়ে বেশ বিরক্ত তিনি। তাঁর কথায়, “রাস্তা জুড়ে হকার আর রিকশা। হাঁটাই মুশকিল হয়ে উঠেছে। তার উপর একটা ভাল সিনেমা হলও নেই।”

Advertisement

এঁদের সবারই বিশ্বাস, এনটিপিসি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়লে শহরের গ্রামীণ ছবি কয়েক বছরের মধ্যেই বদলে যাবে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলতে এনটিপিসিকে পরিকাঠামোর জন্য বিনিয়োগ করতে হবে তাতেই শহরের চিত্র পাল্টে যাবে।

ইতিমধ্যেই এনটিপিসির আর্থিক সহায়তায় কাটোয়া-বলগোনা ব্রডগেজ হতে চলেছে। পূর্ব রেল যাবতীয় দরপত্র ডেকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। কাটোয়াকে ঘিরে রেলেরও একগুচ্ছ পরিকল্পনা রয়েছে। যার মধ্যে কাটোয়া-ব্যান্ডেল ডবল লাইনের কাজ শেষের দিকে এগোচ্ছে। আমোদপুর-কাটোয়া ছোট লাইনও ব্রডগেজ হচ্ছে। কাজ চলছে কাটোয়া থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত ডবল লাইন করারও।

কাটোয়া মহকুমা ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্ণধার মানিক দেবনাথের মতে, “শহরের গতি বাড়লেই বাইরের লোক আসবে। চাহিদা তৈরি হবে। যোগান দেওয়ার জন্য বড় বড় সংস্থা কাটোয়ায় নজর দিতে বাধ্য।” এ কথা মাথায় রেখে এনটিপিসি ব্যবসায়ীদের মানসিকতার বদল ঘটাতেও সচেষ্ট হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন এনটিপিসি কর্তারা। তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প ঘিরে কী রকমের ব্যবসা করলে বা কী ভাবে ব্যবসা বাড়ালে এলাকার বাসিন্দারা সমৃদ্ধ হতে পারেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা চলছে। তা ছাড়াও ব্যবসা করতে গিয়ে যে সব সমস্যা দেখা দেয়, তার মোকাবিলা করতেও সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছে এনটিপিসি। এনটিপিসির এক কর্তার কথায়, “বাইরের বড় বড় সংস্থা এখানে আসার আগে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন করা গেলে আমরা প্রচুর মানব সম্পদ তৈরি করতে পারব। ফলে কর্মসংস্থানের একটা পথ তৈরি হবে।”

এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভাগীরথী-অজয় জলপথকেও ব্যবহার করতে চাইছে এনটিপিসি। শাঁখাই ঘাটে লকগেট তৈরি করা, ভাগীরথী, অজয়ের পাড়ের সৌন্দ্যর্যায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অন্তর্দেশীয় জলপথের কর্তারা ওই জলপথ সমীক্ষা করে গিয়েছেন। নজর রয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবারও দিকেও। কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে মা ও শিশুদের কেয়ার ইউনিট এবং ট্রমা সেন্টার গড়ার জন্য রাজ্য সরকার এনটিপিসির কাছে প্রস্তাব রেখেছে। প্রায় ২৫ কোটি টাকার এই প্রকল্প গড়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের প্রস্তাব মেনে নিতে পারে এনটিপিসি।

এ তো গেল আশার কথা। তবে স্বচ্ছল জীবন যাপনের রকমারি উপকরণ এখনও কাটোয়ায় অপ্রতুল বলেই বাসিন্দাদের মত। শপিং মল থেকে বহুজাতিক নানা সংস্থার শো-রুম, মাল্টিপ্লেক্স থেকে অভিজাত ক্লাব কিছুই এখনও হাত বাড়ায়নি শহরে। শহরবাসীর অভিযোগ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ নেই, সুইমিং পুল নেই, বেশির ভাগ রাস্তার আঁধার ঘোচানোর ভরসা এখনও টিউবলাইট। এমনকী ভাল পার্কও নেই শহরে।

নীচে, বৃষ্টির জলে বেহাল শহরের মাধবীতলা এলাকা।
রাস্তা দখল করে বসেছে দোকান। ছবিগুলি তুলেছেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

কাটোয়া পুরসভার অবশ্য দাবি, শহরের ভিতর ১১টি শিশু উদ্যান রয়েছে। জায়গার অভাবের জন্য বড় পার্ক তৈরি করা যাচ্ছে না। এ ছাড়াও নানা মনীষীদের মূর্তিগুলি সংস্কার করে সৌন্দ্যর্যায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাশাপাশি, শহরের পুরনো এলাকাগুলোর রাস্তা চওড়া করার কাজ শুরু হয়েছে। পুরসভার দাবি, শীঘ্রই শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় উঁচু বাতিস্তম্ভ দেওয়া হবে। কাটোয়ার প্রাক্তন পুরপ্রধান রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শহরকে কী ভাবে পরিকল্পনা মাফিক সাজানো যায়, তার জন্য বিশেষজ্ঞ সংস্থা দিয়ে সমীক্ষা করানো হচ্ছে।”

কয়েক বছর আগে সুবোধ স্মৃতি রোডে পরিত্যক্ত বাজার ভেঙে কলকাতার একটি সংস্থার সঙ্গে পিপিপি মডেলে শপিং মল গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে ভবন বর্তমানে একতলাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই সংস্থা সূত্রে জানানো হয়েছে, সময়ের আগেই কাটোয়াতে শপিং মল তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে জন্যই বারবার বাধা পড়েছে। তাঁদের দাবি, এখন কাটোয়াতে ব্যবসা করার জন্য অনেকে উদ্যোগী হচ্ছেন। তাঁরাও এ বার শপিং মল গড়ার কাজে হাত দেবেন। এছাড়া কলকাতার গহনা প্রস্তুতকারক সংস্থারা কাটোয়া শহরে শো-রুম খুলেছে। সেই শো-রুমের দেখাদেখি কাটোয়াতে বেশ কয়েকটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গহনার দোকান খুলে গিয়েছে। ঝাঁ চকচকে শপিং মল না থাকলেও সাবেক দোকানপাটকে সংস্কার করে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত করে তুলছেন ব্যবসায়ীরা। কয়েকটি অভিজাত বস্ত্র প্রতিষ্ঠান শো-রুম খুলেছে কাটোয়া শহরে।

শহরের নিকাশি ব্যবস্থা নিয়েও বাসিন্দাদের অভিযোগ রয়েছে। বাসিন্দাদের দাবি, শহরের বহু এলাকাতেই বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়। নোংরা জল ঢুকে পড়ে বাড়িঘরেও। মান্ধাতা আমলের নিকাশি ব্যবস্থার হাল না ফিরলে আধুনির শহর হয়ে ওঠা হবে না বলেই তাঁদের মত। আটের দশকে গড়ে ওঠা কাটোয়া স্টেডিয়ামের অবস্থাও খন্ডহর। গ্যালারি ভেঙে পড়ছে। বছরের বেশিরভাগ সময় মাঠ ভর্তি জল থাকে।

কাটোয়ার মহকুমাশাসক মৃদুল হালদারের আশ্বাস, “স্টেডিয়াম সংস্কার, সুইমিং পুল গড়া ও ভাগীরথী-অজয় পাড়ের সৌন্দর্য্যায়ন নিয়ে উদ্যোগ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সাংসদ সুনীল মণ্ডলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।”

তবে সব সমস্যা ছাপিয়ে এঁদো গলি, রিকশার ভিড়, রাস্তা দখল করে হকারদের উৎপাত, গরু-মোষের খাটালকে পিছনে ফেলে দিয়ে আভিজাত্যের মোড়কে সেজে উঠবে শহর, এমনটাই স্বপ্ন দেখছেন কাটোয়ার বাসিন্দারা।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন