বাধ্যতামূলক নিয়ম না মেনে, কার্যত গ্রাহকদের ঠকিয়েই অবাধে চলছে রেশন দোকান, এমনই তথ্য মিলেছে কাটোয়া মহকুমার খাদ্য নিয়ামক দফতরের রিপোর্টে। নিয়ম না মানায় গত তিন মাসে চার জন ডিলারকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে, আরও ছ’জনকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে গ্রাহকদের একটা বড় অংশের ধারনা, এলাকার বাসিন্দাদের চাপেই ওই সব রেশন ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে খাদ্য নিয়ামক দফতর। সে কথা মেনেও নিয়েছেন খাদ্য দফতরের কর্তারা। কাটোয়া মহকুমা খাদ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দিন কয়েক আগে কাটোয়া ২ ব্লকের মুল্টি গ্রামে সাত সকালে কেরোসিন পাচারের খবর পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা হৈচৈ শুরু করে দেন। খবর পেয়ে বিডিও আধিকারিকদের ওই গ্রামে পাঠান। গ্রামবাসীদের অভিযোগ শুনে বিডিওর কাছে রিপোর্ট করেন আধিকারিকরা। বিডিও রিপোর্টটি মহকুমা খাদ্য নিয়ামক দফতরে পাঠানোর পরে তারা পৃথক ভাবে তদন্ত করে জানতে পারেন যে জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (শপ নম্বর ৯৯) গ্রাহকদের কেরোসিন তেল বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। এর পরেই ওই ডিলারকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হয়। কাটোয়া ১ ব্লকের বিজনগর গ্রামেও ত্রাণ ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর থেকে গরীবদের জন্য যে চাল-গম বরাদ্দ করা হয় (জি আর), তা সঠিক পরিমাণে দেওয়া হচ্ছিল না বলে অভিযোগ ওঠে। গ্রামবাসীদের অভিযোগ করেন, তাঁদের পাওনা ১৪৪ কিলোগ্রাম গম, সেখানে রেশন ডিলার তারকনাথ পাল (শপ নম্বর ২৫) ২৫ কিলোগ্রাম চাল দিচ্ছিলেন। অভিযোগ পাওয়ার পরে বিজনগরে পৃথক ভাবে তদন্তে নামে খাদ্য দফতর ও ত্রাণ বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর। পরে বেশ কিছু বেনিয়ম মেলায় ওই ডিলারকে শো-কজ করা হয় বলে খাদ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।
কী কী বেনিয়ম মিলেছে? খাদ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, প্রতিটি রেশন দোকানে দ্রব্য মূল্যের তালিকা প্রকাশ্যে টাঙিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়াও চাল, গম, চিনির নমুনা রাখতে হবে, যাতে গ্রাহকেরা জিনিস কেনার পরে মিলিয়ে দেখতে পারেন। গ্রাহকদের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার জন্য অভিযোগপত্রও রাখতে হবে ডিলারকে। এছাড়া রাজ্য সরকারের নিয়ম অনুযায়ী রেশন দোকানে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রও রাখতে হবে। কাটোয়া মহকুমার এক খাদ্যকর্তা বলেন, “জি আর চাল-গমের ত্রুটি আছে কি না তা তদন্ত করে দেখছে ব্লকের ত্রাণ ও বিপর্যয় দফতর। তবে ওই ডিলার যে নিয়মভঙ্গ করেছেন তার প্রমাণ মিলেছে।” তবে শুধু ওই দোকানই নয়, কাটোয়া মহকুমার ২৫৫টি রেশন দোকানই নিয়মবর্হিভূত ভাবে চলছে বলে খোঁজ মিলেছে। ওই কর্তা বলেন, “ঠক বাজতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। নিয়ম অনুযায়ী, মঙ্গলবার দোকান খোলার কথা। কিন্তু শহরে বৃহস্পতিবার আর গ্রামে শুক্রবারের আগে রেশন দোকান খোলে না। অন্ত্যোদয় যোজনা ও বিপিএল তালিকাও বেশিরভাগ রেশন দোকানে থাকে না।”
আর নিয়ম না মানার শাস্তি? খাদ্য দফতরের কর্তারা জানান, কেরোসিন ডিলারদের গরমিল ধরা পড়লে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, চাল-গম ডিলারদের জন্য ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। এর সঙ্গে অভিযুক্ত রেশন ডিলারদের শো-কজ করা হয়। এমনকী রেশন ডিলারদের বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হলে বরখাস্ত পর্যন্ত করা হয় বলে জানান কর্তারা। কাটোয়া মহকুমা খাদ্য নিয়ামক দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক অমৃত ঘোষ বলেন, “ডিলারদের কোনও গাফিলতি দেখলে আমরা নিয়ম মেনে ব্যবস্থা নিই।” ওয়েস্ট বেঙ্গল এম আর রেশন ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক পরেশচন্দ্র হাজরার বক্তব্য, “সংগঠনের তরফে পরিস্কার বলা আছে যে সমস্ত নিয়ম মেনে দোকান চালাতে হবে। খাদ্য দফতের কর্তারা ঠিক মতো পরিদর্শন করলে গাফিলতিও অনেক কমে যাবে।”
যথাযথ পরিদর্শন যে হয় না তা স্বীকার করে নিয়েছেন খাদ্য দফতরের একাধিক কর্তা। কাটোয়া মহকুমার এক খাদ্য কর্তা বলেন, “কাটোয়াতে দেড় বছর ধরে কোনও খাদ্য নিয়ামক নেই। মুখ্য পরিদর্শক রয়েছেন এক জন। কর্মীর অভাবে ভুগছে আমাদের দফতর।” দফতর সূত্রে জানা যায়, মহকুমায় ৮ জন পরিদর্শকের জায়গায় রয়েছেন তিন জন। ১৪ জন অবর পরিদর্শকের (এস আই) জায়গায় আছেন মাত্র ৪ জন। ওই দফতরের মুখ্য পরিদর্শক অসীম সিংহ রায় বলেন, “এ অবস্থায় যতটা সম্ভব পরিদর্শন করা সম্ভব আমরা করছি।”