শক্তির পুজোতেই মুক্তি খোঁজেন দক্ষিণ শ্রীরামপুরের মহিলারা

টাকাপয়সার অভাবে একসময় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল বছর বারোর পুরনো পুজোটি। কোনও ভাবেই কাজকর্ম সামলে পুজোর খরচ জোগাড় করা বা পুজোর ব্যবস্থাপনা সামাল দিতে পারছিলেন না কর্তারা। ঘর থেকে বেরিয়ে তখন শক্তি আরাধনার হাল ধরেন গিন্নিরাই। তারপর পার হয়ে গিয়েছে তিন বছর। পূর্বস্থলীর দক্ষিণ শ্রীরামপুর এলাকার অন্যতম কালীপুজো এখন এটি।

Advertisement

কেদারনাথ ভট্টাচার্য

পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৩৩
Share:

চলছে দেবীবরণ।—নিজস্ব চিত্র।

টাকাপয়সার অভাবে একসময় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল বছর বারোর পুরনো পুজোটি। কোনও ভাবেই কাজকর্ম সামলে পুজোর খরচ জোগাড় করা বা পুজোর ব্যবস্থাপনা সামাল দিতে পারছিলেন না কর্তারা। ঘর থেকে বেরিয়ে তখন শক্তি আরাধনার হাল ধরেন গিন্নিরাই। তারপর পার হয়ে গিয়েছে তিন বছর। পূর্বস্থলীর দক্ষিণ শ্রীরামপুর এলাকার অন্যতম কালীপুজো এখন এটি।

Advertisement

পূর্বস্থলী ব্লক অফিস থেকে ডানদিকে নেমে গিয়েছে সরু ঢালাই রাস্তা। রাস্তার শেষ মাথায় পুজো মণ্ডপ। ফুল, আলো, আলপনায় সাজানো মণ্ডপে আড়ম্বর না থাকলেও আন্তরিকতার অভাব নেই। গ্রামের প্রবীণদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, ছাত্র সঙ্ঘ নামে একটি ক্লাব এ পুজো শুরু করে। তারপর একসময় টাকাপয়সার অভাব, আরও সাত-সতেরো সমস্যায় পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। তখন বিজয়া কালীমাতা পুজো কমিটি নাম নিয়ে এগিয়ে আসেন বাড়ির মেয়েরা। ঠাকুর বায়না করা থেকে চাঁদা তোলা, পুজোর বাজারহাট সব দায়িত্ব তাঁরাই তুলে নেনে কাঁধে। তারপর থেকে উৎসব আড়েবহরে বেড়েছে বই কমেনি। এখন এলাকার প্রায় হাজার তিনেক মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থাও করেন ওই মহিলারা। রীতিমতো পাত পেড়ে পরিবেশন করে খাওয়ানো হয় পুজো দেখতে আসা হাজারো লোকজনকে। পুজো কমিটির সম্পাদক সুষমা দেবনাথের কথায়, “আমাদের পুজোয় আন্তরিকতাই সব। একসময়ের প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পুজো নিজেদের উদ্দ্যোমে ফিরিয়ে এনেছি আমরা।”

পুজো কমিটির অন্যান্য সদস্যেরা জানান, কালীপুজোর সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তাঁরা। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গিয়ে পালবাড়িতে ঠাকুর বায়না দেওয়া, চাঁদা তোলা, বাজার হাট করানিজেরাই করেন সব। দিন চারেক আগে শুরু করেন মণ্ডপ সাজানো। আলপনা এঁকে, ফুল, মালা, আলো দিয়ে সাজিয়ে নিজেরাই সাজিয়ে তোলেন মণ্ডপ। তবে শুধু পুজো নয়, তিন দিনের উৎসবে এলাকার দুঃস্থ পড়ুয়াদের খাতা-পেন দেওয়া, গরিবদের শীতবস্ত্র বিতরণও করেন তাঁরা। সবিতা মজুমদার নামে এক সদস্যা বলেন, “পুজো তো সবার। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ওঁদেরও একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা।”

Advertisement

বৃহস্পতিবার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মণ্ডপের সামনের ঢালাই রাস্তায় ভিড় জমিয়েছেন প্রায় শ’খানেক মহিলা। তাঁদের কেউ তাঁত শ্রমিক, কেউ কলেজ পড়ুয়া, কেউ আবার গৃহবধূ। বিকেল চারটে নাগাদ সারিবদ্ধ ভাবে কিলোমিটার দুয়েক দূরে মুড়িগঙ্গার দিকে রওনা দিলেন তাঁরা। সবার হাতেই কাঁসার থালায় ধূপ, প্রদীপ-সহ নানা মাঙ্গলিক জিনিসপত্র। ঘাটে পৌঁছতে দেখা গেল সেখানে আগে থেকেই হাজির হয়েছে নবদ্বীপের স্কুল পড়ুয়াদের ব্যান্ডপার্টি। ততক্ষণে মহিলাদের সংখ্যাও দুশো ছাড়িয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা নাগাদ নদী থেকে ঘট ভরে কাছাকাছি চৌরঙ্গি মোড়ে পৌঁছন তাঁরা। সেখানে পালবাড়িতে শুরু হয় দেবীবরণ। তারপর প্রতিমা গাড়িতে তুলে আনা হয় মণ্ডপে। পথে মহিলাদের শোভাযাত্রা দেখতেও ভিড় জমান অনেকে। মহিলারাও রীতিমতো মাইক নিয়ে পুজো দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান আশপাশের বাসিন্দাদের। মণ্ডপে ফিরে শুরু হয় আরেক প্রস্থ ঠাকুর বরণ। তবে বরণের পরেই কোমর বেঁধে পুজোয় আয়োজন শুরু করে দেন মহিলারা। পুজো মণ্ডপ লাগোয়া একটি আমগাছের তলায় শুরু হয় রান্না। মহিলারাই জানান, পুজো উপলক্ষে তিন হাজার মানুষের রান্না নিজেরাই করেন তাঁরা। এ বছরের মেনু, খিচুড়ি, পাঁচমেশালি তরকারি ও পায়েস। পুজো কমিটির সদস্যেরা আরও জানান, এ বার শ’খানেকেরও বেশি মহিলা প্রতিমা বিসর্জনে যোগ দেবেন। তাদের জন্যে ইতিমধ্যে লাল পাড় সাদা শাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

এ গ্রামে ঘরের কাজ ছাড়াও বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শাড়ি, গামছা বোনার কাজ করেন মহিলারা। ব্যতিক্রম শুধু কালীপুজোর দিন। সবিতাদেবী, সুষমা দেবী, মায়া দেবীরা জানান, শক্তির আরাধনা ছাড়াও তিনদিনই নিজেদের জন্য নানা বিনোদন, প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন তাঁরা। যেমন, ফুচকা খাওয়া, শাঁখ বাজানোর প্রতিযোগিতা। তাঁদের কথায়, “বছরভর চার দেওয়ালের আবদ্ধ থাকি আমরা। এ ক’দিন নিজের মতো করে বাঁচি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন