রাজনীতি করতে গিয়ে আর স্কুলে ফিরতে পারেননি। অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের পেনশন দেওয়ার অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে তিনি, রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ জানতে চাইলেন, “আমার পেনশনটা কবে হবে? আমি তো অবসর নিয়েছি।”
সোমবার বর্ধমানের টাউন হলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের একটি ওয়েবসাইট উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ৩৪ জন প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকার হাতে পিএফের চেক তুলে দেওয়া হয়। তাঁরা মোটে পাঁচ দিন আগে, গত ৩১ ডিসেম্বর অবসর নিয়েছেন। এর জন্য তৃণমূল প্রশাসনের কৃতিত্ব দাবি করে মন্ত্রী বলেন, “মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে পিএফের টাকা মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এই ঘটনা সত্যিই বিরল।” তাঁর কথায়, “আমার বাবাও প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন। তাঁকে পেনশন পেতে প্রচুর হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছিল। আগে তো ‘প্রাইমারি’ শিক্ষকদের বলা হতো ‘প্রায় মরা’ শিক্ষক। মুদির দোকান তাঁদের ধার দিত না, কেউ সহজে তাঁদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না। এখন অবশ্য অবস্থা বদলেছে।”
পূর্বস্থলীর জাহাননগর কুমারানন্দ হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক স্বপনবাবুর পেনশন সংক্রান্ত কাগজপত্র জেলা স্কুল পরিদর্শকের (ডিআই) অফিসে জমা হয়েছে। কিন্তু তিনি কবে পেনশন পাবেন, তা এখনও জানানো হয়নি। আসলে শিক্ষক পদে স্বপনবাবুর চাকরি নিয়েই ইতিমধ্যে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে তিনি পূর্বস্থলীর ওই স্কুলে শিক্ষকের স্থায়ী পদে চাকরি পেয়েছিলেন। দু’বছর পরে বিএড পড়তে যান। কিন্তু তার পরে, ১৯৭৮ সালে আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তদানীন্তন বাম সরকার আর তাঁকে স্কুলে ফিরতে দেয়নি বলে অভিযোগ। স্কুলে ঢুকতে চেয়ে স্বপনবাবু হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। হাইকোর্ট তত্কালীন ডিআই-কে শুনানি করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু স্বপনবাবু তাঁর পিএফের টাকা তুলে নিয়েছেন, এই যুক্তিতে তাঁকে আর চাকরিতে ফিরতে দেওয়া হয়নি। এর পরে হিসেব মতো ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁর কর্মজীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে, অর্থাত্ শিক্ষকতায় বহাল থাকলে তার পর থেকে তাঁর অবসর শুরু।
স্বপনবাবুর দাবি, “খিদের জ্বালায় কেউ পিএফের টাকা তুলে নিলে তাঁকে চাকরি ফেরত দেওয়া হবে না, এমন কথা আইনে বলা নেই। আমি স্কুল থেকে পদত্যাগও করিনি। আমাকে স্কুলের পরিচালন সমিতি বরখাস্তও করেনি। আমার পদে কোনও শিক্ষককেও নিতে পারেনি স্কুল। ফলে ওই স্কুলের কাছ থেকে আমার লক্ষ-লক্ষ টাকা পাওনা। টাকাগুলো পেলে আমি সেটা স্কুলকেই দান করে দেব। তবে পেনশন পাওয়াটা আমার অধিকার। সেই অধিকারের জন্য আমি লড়াই করছি।” তৃণমূলের শিক্ষক নেতা রথীন মল্লিক বলেন, “স্বপনবাবুর চাকরি সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র ডিআই অফিস থেকে লোপাট হয়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে মাত্র ছ’মাস আগে আমরা ওঁর নতুন ফাইল তৈরি করেছি। উনি যাতে পেনশন পান, তার জন্য আমরাও চেষ্টা করছি।” রাতে ভারপ্রাপ্ত ডিআই মালবিকা সাহা অবশ্য বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারব না।”
স্বপনবাবুর হিল্লে না হলেও অবসরের পাঁচ দিনের মধ্যে কিছু শিক্ষককে পিএফ-এর টাকা পাইয়ে দিতে পেরে প্রশাসনের কর্তারা নিজেরাই খুশি। বর্ধমান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি অচিন্ত্য চক্রবর্তীর দাবি, “অবসরের মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় এই যে ৩৪ জন শিক্ষককে পিএফের টাকা দেওয়া হল, তা রাজ্যের আর কোনও জেলায় ঘটেনি। যে ওয়াবসাইটের উদ্বোধন হল, তাতেও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রচুর সুবিধা হবে। বাড়িতে বসে কম্পিউটারের মাউস ক্লিক করেই তাঁরা সংসদের সমস্ত নির্দেশিকা, সরকারি আদেশ, বিভিন্ন আবেদনের জন্য ফর্ম ও পেনশন সংক্রাম্ত তথ্য, জেলায় কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা কী রকম, তা জানতে পারবেন।”