ছুতোয়-নাতায় লড়াই লেগেই থাকত দুই বাড়ির। কখনও জমিজমা নিয়ে আবার কখনও গ্রামের কোনও বিষয়ে বছরভর মনকষাকষি চলত। এমনকি কখনও কখনও একে অন্যকে হারাতে লেঠেল নামাত হালদার বাড়ি আর পোদ্দার বাড়ি। কিন্তু সন্ধি পুজোর সময় এলেই কোলাকুলি করে দুই পরিবারের সদস্যেরা একে অপরকে কাছে টেনে নিতেন।
বহু বছর চলা এই রীতি এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কালনার বাদলা গ্রামে। অষ্টমীর দিন পোদ্দার বাড়ির সমস্ত পুরুষ সাদা ধুতি, গেঞ্জি পরে দল বেঁধে হাজির হন হালদার বাড়িতে। দুর্গাপ্রতিমা দর্শনের পরে চলে সারা বছরের ঝুটঝামেলা ভুলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনিময়ের পালা। তারপর ফিরে যান বাড়ির পুজোয়। তবে এখন শুধু পোদ্দার বাড়ি নয়, গ্রামের আরও অনেক পরিবারই সন্ধিপুজোর আগে হাজির হয়ে যান হালদার বাড়িতে। লোক সমাগমে গমগম করে ওঠে পুরনো এই পুজো।
গ্রামের প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, জেলার প্রাচীন পুজোগুলির অন্যতম এই পুজো। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা থেকে ব্যবসা করতে বাংলায় এসেছিলেন পোদ্দার পরিবারের পূর্বপুরুষ। তারপর থেকে বাদলাতেই স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। এই পরিবারের দুই সদস্য দিগম্বর দে পোদ্দার এবং লক্ষ্মীনারায়ণ দে পোদ্দার ১৬০৩ সালে দুর্গাপুজা শুরু করেন। পরিবারের নানা পুরনো নথিতেও এই পুজোর উল্লেখ রয়েছে। প্রতিমা গড়া থেকে শুরু করে পুজোর যাবতীয় কাজ সারা হয় বাড়ির পাশের আলাদা মণ্ডপে। চারশো বছরের পুরনো এই প্রতিমা সাধারণ মূর্তির থেকে কিছুটা আলাদা। একচালার প্রতিমার পাশে ষাঁড়ের পিঠে থাকেন শিব। হর-পাবর্তীর পাশে থাকে দেবীর দুই সখী জয়া-বিজয়াও। মহালয়ার রাতে অধিবাস হয়ে শুরু হয়ে যায় এই পুজো। মাসখানেক আগে থেকে মণ্ডপ তৈরি, ঘরবাড়ি সাফসুতরো করারও ধুম পড়ে যায়। আর পুজোর সপ্তাহখানেক আগে শুরু হয় দেবীর নৈবেদ্যর মিষ্টান্ন তৈরি। দূরদূরান্ত থেকে ভিড় জমাতে শুরু করেন আত্মীয়-স্বজনেরা। বংশ পরম্পরা মেনে প্রতিবার খাতায় লিখে রাখা হয় পুজোর খরচেও হিসেবও। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পোদ্দার বাড়ির পুজোয় দেবীর নৈবেদ্য সাজানো হত ৮১টি কাঁসার থালায়। কিন্তু পুজোর বাসন চুরি হয়ে যাওয়ায় সে রেওয়াজ ভেঙেছে।
পরিবারের সদস্যেরা জানান, আগে গ্রামের সমস্ত ব্রাহ্মণ ঘরে নৈবেদ্য পৌঁছে দেওয়া হত। তবে এখন আর্থিক কারণে ততটা আর করা যায় না। বলি নয়, প্রতি বারই দেবীকে পাঁচটি ফল উৎসর্গ করা হয় এ পুজোয়। ৪১২ বছরে পা রাখা কালনার এ পুজোয় রয়েছে কনকাঞ্জলি প্রথাও। এই প্রথা অনুযায়ী দশমীর দিন সুতো কাটার আগে একটি থালায় রাখা হয় চাল ,কলা, প্রদীপ, রুপোর কয়েন, কড়ি, সিঁদুর ও পান। দেবীর পা ছুঁয়ে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে ওই থালা রেখে দেওয়া হয় বাড়িতে। ওই বাড়ির এক সদস্য কৌশিক দে বলেন, “আমাদের বাড়ির সব প্রজন্মের কাছে দুর্গাপুজো অত্যন্ত আনন্দের। এত বছরেও তাই সমানে চলছে পুজো।”
তবে হালদার বাড়ির পুজো এখন অনেকটাই ম্লান। পরিবারের সদস্যেরা গ্রামে কেউ থাকেনও না। স্থানীয়রা জানান, পুজোর আগে অবশ্য সবাই হাজির হন বাড়িতে। যথাসম্ভব আচার মেনে পুজো সেরে কলকাতায় ফিরে যান তাঁরা।
তবে জমজমাট হোক বা ফিকে, যে অসুর নিধনে দেবীর আগমন, সেই ঝগড়া-বিবাদ ভুলে গিয়ে প্রতি পুজোয় এক হওয়াটাই আসল পুজো দুই পরিবারের।