সাত দিন অনশনও করেছিলেন বড়মা

মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেও তিনি বড়মার আরোগ্য কমনায় লীলামৃত ও হরিসঙ্গীত করেছেন। রাতেই অবশ্য বড়মার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন তিনি। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘‘তিরিশ বছর ধরে বড়মার সঙ্গে রয়েছি। আমাকে উনি মা বলে ডাকতেন। বলতেন মা খেতে দাও, জল দাও। আর বড়মা কখনও খেতে চাইবেন না ভাবতেই পারছি না।’’

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

গাইঘাটা: শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ০৩:০৮
Share:

শেষ-যাত্রা: গাইঘাটায় ঠাকুরবাড়িতে বড়মার দেহ আনা হচ্ছে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

সাদা কাপড় পরে বড়মার ঘরের বন্ধ দরজার সিঁড়িতে দরজার পাশে চুপ করে বসে আছেন তিনি। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন বড়মা বীণাপাণি ঠাকুরের ছায়াসঙ্গী। বড়মাকে খাওয়ানো, স্নান করানো, শোয়ানো সবই নিজে হাতে করতেন সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধা মিনতি মণ্ডল।

Advertisement

মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেও তিনি বড়মার আরোগ্য কমনায় লীলামৃত ও হরিসঙ্গীত করেছেন। রাতেই অবশ্য বড়মার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন তিনি। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘‘তিরিশ বছর ধরে বড়মার সঙ্গে রয়েছি। আমাকে উনি মা বলে ডাকতেন। বলতেন মা খেতে দাও, জল দাও। আর বড়মা কখনও খেতে চাইবেন না ভাবতেই পারছি না।’’

মিনতি জানান, মিষ্টি ও দুধও ছিল তাঁর প্রিয়। গোটা শীত সুস্থই ছিলেন বড়মা। তবে শেষ বেলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশে থাকাকালীন বড়মার সঙ্গে পরিচয় মিনতির। তাঁর কথায়, ‘‘বড়মা ও প্রমথরঞ্জন ঠাকুর আমাকে তিনবার বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিলেন। খুব ভালবাসতেন। বাকি দিনগুলো কী ভাবে কাটব জানি না।’’

Advertisement

বড়মার মৃত্যুতে মিনতির মতো অসংখ্য ভক্ত ভেঙে পড়েছেন। মতুয়া ধর্ম প্রচারক রবি হালদার বলেন, ‘‘বড়মাকে বহু মতুয়া ধর্ম সভায় নিয়ে গিয়েছি। আমাকে ছেলের মতো দেখতেন। বড়মার বড় ছেলে প্রয়াত কপিলকৃষ্ণকে তিনি একটি তাবিজ দিলে আমাকেও দিতেন। মাকে হারালাম।’’ ঠাকুরবাড়ি সূত্রে জানা গেল, অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার জব্দকাঠি গ্রামে অষ্টমী তিথিতে বড়মা বীণাপাণি ঠাকুর জন্মেছিলেন। বাবা অশ্বিনী সাধক, মা বিনোদিনী সাধক ও পাঁচ ভাইবোনের সঙ্গে তাঁর বড় হওয়া। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেবদেবীর পুজো করতেন। মতুয়া ধর্মগুরু গুরুচাঁদ ঠাকুর, প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের সঙ্গে বীণাপাণির বিয়ে দেন।

১৯৪৬ সালে প্রথমরঞ্জনের সঙ্গে বড়মা এ দেশে চলে আসেন। প্রথমে কলকাতা ও বগুলাতে কিছুদিন ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তাঁরা ঠাকুরনগরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঠাকুরবাড়ির উন্নয়নমূলক কাজের পরিচালক হন। ১৯৫৫ সালে তাঁর নামে ঠাকুরবাড়িতে বীণাপাণি প্রেস তৈরি হয়। ১৯৬৪ সালে প্রমথরঞ্জন ঠাকুর গ্রেফতার হন ভারত রক্ষা আইনে। সে সময় বড়মা ভক্তদের নিয়ে ৭ দিন অনশন করেছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা হন বীণাপাণিদেবী। আমৃত্যু ওই পদে ছিলেন। কৃষিকাজেও বড়মা পারদর্শী ছিলেন। বড়মার কাজের আলোচনা করছেন মতুয়া ভক্তরা। বনগাঁর বাসিন্দা দেবাশিস বারুই এ দিন বড়মাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঠাকুরবাড়িতে এসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘‘তিনবার বড়মার পা ছুঁয়েছি। আর ছুঁতে পারব না। বড়মা নেই আর হয়ত ঠাকুরবাড়ি আসা হবে না।’’ বনগাঁর বাসিন্দা এক মতুয়া ভক্ত মনোজ ঠিকাদার বলছিলেন, ‘‘বড়মাকে ঘিরে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। এ বার হয়ত মতুয়ারা রাজনৈতিক ভাবে ভাগ হয়ে যাবেন।’’

স্বামীর নামাঙ্কিত মন্দিরের পিছনে আজ, বুধবার বড়মাকে দাহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চোখের জলে তাঁদের প্রিয় বড়মাকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত মতুয়া ভক্তরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন