বিডিও অফিসে পর্যবেক্ষক।—নিজস্ব চিত্র
‘‘চারদিকে এত ভোট ভোট, নিজের ভোটটা আদৌ নিজে দিতে পারবো!’’ দাওয়ায় বসে চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা বলছিলেন মাঝবয়সী তিন মহিলা।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কী ভাবে যেন কথাটা কানে আসে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ নজরদারি দলের পর্যবেক্ষক রাজীব কুমার জৈন। সটান এগিয়ে যান তিনি। প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে যান ওই মহিলারা। বলতে থাকেন, ‘‘না না। নিজেদের ভোট নিজেরাই দিই। কেউ ভয় দেখায় না আমাদের।’’
মুখ থেকে কথাটা খসতে না খসতেই পরের প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন পর্যবেক্ষক। দোভাষীর কাজ করছিলেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। বললেন, —সব মেয়েরা ভোট দেয় এখানে? এ বারও উত্তর এল— ‘হ্যাঁ’। এখানে কি কোনও দিন গোলমাল হয়েছে? এ বার কোনও আশঙ্কা আছে বলে মনে হচ্ছে? জটলার মধ্যে থেকে মুখ খুললেন এক বৃদ্ধা। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘‘না বাবা, আগে কোনও দিন হয়নি। তবে এ বার কী হবে, তা বাপু বলতে পারব না।’’
উত্তরটা শুনে কী যেন একটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন রাজীব কুমার। এক বার প্রশাসনের কর্তাদের দিকে তাকিয়েই সোজা হাঁটা দিলেন। নবদ্বীপের বামুনপুকুর হাইস্কুলের সামনে থেকে আবার গাড়িতে উঠে সোজা চলে এলেন কৃষ্ণনগরের সার্কিট হাউজে।
সোমবার দুপুরেই নদিয়া জেলায় পা রেখেছেন রাজীবকুমার জৈন। তার পর থেকেই টানা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন। দুপুরে জেলা প্রশাসনিক ভবনে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন স্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান, আরও বেশি সংখ্যক ভোটারদের বুথমুখী করা যায় কী ভাবে। তার জন্য জেলা প্রশাসন কী করেছে। বিশেষ করে নতুন ভোটার ও মহিলাদের ভোট দানে উৎসাহিত করতে ঠিক কি কি সচেতনতামূলক পদক্ষেপ করা হয়েছে। পরে সাংবাদিক বৈঠকে রাজীব কুমার বলেন, ‘‘নদিয়ায় গত লোকসভা ভোটে ৮৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল। রাজ্যের ভোটের থেকে বেশি। সেই হিসাবে এই জেলার অবস্থা ভালই। তবে আমরা সংখ্যাটা আরও বাড়াতে চাই।’’
মধ্যাহ্নভোজন সেরে বিকেল চারটে নাগাদ ফের বেড়িয়ে পড়েন নবদ্বীপ ব্লক অফিসের উদ্দেশে। আগেই থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন বিডিও মধুমালা নন্দী। তার কাছেও জানতে চান ভোটদানে উৎসাহ বাড়াতে ঠিক কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে। জানতে চান এই ব্লকে শুধু মহিলা ভোটার আছে এমন কোন বুথ আছে নাকি? বিডিও জানিয়ে দেন, না। তবে মহিলাদের জন্য আলাদা সুযোগসুবিধা থাকছে, জানিয়ে দেন তিনি। তবে এতেই সন্তুষ্ট হননি পর্যবেক্ষক।
—‘‘পানীয় জল, শৌচাগার থাকছে বুথে?’’ বিডিও বলেন,‘‘হ্যাঁ।’’ —‘‘কতগুলো বুথে ঘুরেছেন?’’ খানিক থেমে বিডিও এ বার উত্তর দেন, ‘‘স্যার, ৯০ শতাংশ।’’ খানিক কড়া গলায় প্রশ্ন করেন, ‘‘বাকি বুথগুলো কে দেখবে?’’ থতমত খেয়ে মধুমালাদেবী বলেন, ‘‘মানে স্যার, আমিই দেখব।’’
ফের জানতে চান, ‘‘ভোটারদের সচেতন করতে আপনারা কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? নতুন কী করলেন?’’ এ বারও থতমত খেয়ে যান বিডিও মধুমালাদেবী। আবারও এক প্রশ্ন। আরও কড়া সুরে। সকলে পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষে আসরে নামেন জেলা প্রশাসনের একশো দিনের প্রকল্প আধিকারিক বাবুলাল মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘২৫ জানুয়ারি নতুন ভোটারদের উৎসাহিত করতে তাদের সঙ্গে প্রশাসন ফুটবল খেলেছে। তা ছাড়া যে সব এলাকায় আগে ভোট কম পড়েছে, সেখানে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সংকল্পপত্র দেওয়া হবে। ওই ছাত্রছাত্রীরাই তার অভিভাবকদের দিয়ে সেই সংকল্পপত্রে সই করিয়ে আনবে। সচেতন করবে ভোটদানে।’’ বাবুলালবাবুকে থামিয়ে দিয়ে রাজীব কুমার এ বার প্রশ্ন করেন,‘‘এ সব তো জেলা স্তরের উদ্যোগ। ব্লক স্তরে কী করা হয়েছে?’’ সকলেই চুপ। শেষে তিনি বলেন,‘‘ব্লক স্তরেও ভোটারদের উৎসাহিত করতে নতুন নতুন ‘আইডিয়া’ প্রয়োগ করতে হবে।’’
এর পর তিনি সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান নবদ্বীপ ব্লকের বামুনপুকুর এলাকায়। বামুনপুকুর হাইস্কুলে ১১৭ নম্বর বুথে গত লোকসভা ভোটে ৭৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে এক মাঝবয়সী ব্যাক্তিকে ডেকে জানতে চাইলেন, ‘‘ভোট দিতে কোন সমস্যা হয়?’’ ‘না’ উত্তরটায় খুব একটা সন্তুষ্ট হয় না তিনি। স্কুলের পাশ দিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে আরও ভিতরে ঢুকতে থাকেন। একটা মিষ্টির দোকানের সামনে বসে থাকা এক বৃদ্ধাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। দোভাষীর মাধ্যমে তাঁর কাছে জানতে চান, এই এলাকায় ভোট দিতে যান না এমন কেউ আছেন কি না? এ বারও উত্তর আসে, ‘না’। —‘‘তা হলে অন্য জায়গার থেকে এখানে ৬ শতাংশ ভোট কম পড়ে কেন?’’ এমন প্রশ্ন শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বৃদ্ধ উত্তর দেন, ‘‘আসলে বাবু এখানকার মানুষ খুব গরীব। পেটের টানে তারা বাইরে কেরলে, দিল্লিতে কাজ করতে যায়। ভোটের সময় সকলে ফিরতে পারে না।’’ ঘাড় নাড়তে থাকেন রাজীব কুমার। ‘‘না না, তা বললে চলবে না, ভোট দিতেই হবে,’’ নিজের মনেই বলতে থাকেন তিনি।