পঞ্চায়েত নির্বাচনে ই-মেলের মাধ্যমে মনোনয়নকে বৈধতা দিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের উপর বৃহস্পতিবার স্থগিতাদেশ জারি করল সুপ্রিম কোর্ট। ফলে ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোট হতে আর কোনও বাধা থাকল না। হাইকোর্টের রায়কে ‘ব্যাড অর্ডার’ বলেও মন্তব্য করেন শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি।
কিন্তু একই সঙ্গে পঞ্চায়েতের ৩৪% আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীদের জিতে যাওয়াকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, আদালতের অনুমতি ছাড়া ওই সব আসনের ফল ঘোষণা করে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করা যাবে না। আগামী ৩ জুলাই এ বিষয়ে ফের শীর্ষ আদালতে শুনানি হবে।
এ দিনই কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, ভোটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন যখন সন্তুষ্ট তখন আদালতের কিছু বলার নেই। কমিশন যে দিন চায়, ভোট করতে পারে। তবে, একই সঙ্গে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, পঞ্চায়েত ভোটে অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা, বিশেষত হিংসাত্মক কোনও ঘটনা ঘটলে, তার দায় কমিশন ও রাজ্যের।
ভোট প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের নির্দেশ, গণতন্ত্রে ভোটের পবিত্রতা বজায় রাখতে পুরোপুরি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভাবে নির্বাচন করাতে হবে।
এ দিকে, কী কারণে তিন দফায় ভোট না করে একদিনে তা করতে হল, সেই প্রশ্ন তুলে অন্য একটি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার ও বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ এ দিনই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চায়, ভোটের দিন স্থির করার আগে সব পক্ষের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ে অর্থবহ বৈঠক করতে বিচারপতি সুব্রত তালুকদার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও দিন ঘোষণার পরে বৈঠক হল কেন? ২৮ এপ্রিলের সেই বৈঠকের লিখিত আলোচ্য বিষয় (মিনিটস) আজ, শুক্রবার সকালে পেশ করার জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ।
সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের নির্দেশে শাসক ও বিরোধী দু’পক্ষই খুশি। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বলছেন, ১৪মে ভোটে আর কোনও বাধা থাকল না। দলের সাংসদ তথা আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি, ‘‘সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস নেতারা ১৪মে ভোট আটকাতে চেয়েছিলেন। নেতাদের এবার কোর্ট ছেড়ে মাঠে নামতে হবে।’’ উল্টোদিকে সিপিএম, বিজেপি নেতাদের সন্তুষ্টির কারণ, ই-মনোনয়নকে হাতিয়ার করে লড়াই করতে নেমে পঞ্চায়েতের প্রায় ২০ হাজারের কাছাকাছি আসনে ভোট নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দেওয়া গিয়েছে।
সিপিএমের আর্জিতেই কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ই-মেলের মাধ্যমে মনোনয়ন জমা দেওয়াকে বৈধ বলে গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয়। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা দায়েরের পর বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতির কাছে দ্রুত শুনানির আবেদন জানান কমিশনের আইনজীবী। ঠিক হয়, দুপুর ২টোয় শুনানি হবে। দুপুরে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে কমিশনের আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদীর প্রধান যুক্তি ছিল, ১৪মে ভোটগ্রহণের মাত্র ছ’দিন আগে কলকাতা হাইকোর্ট বলছে, ই-মেলে জমা মনোনয়নকে বৈধ বলে গ্রহণ করতে হবে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুযায়ী তা গ্রহণযোগ্য। অথচ ইতিমধ্যেই পোস্টাল ব্যালট ছাপিয়ে পাঠানো হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া, জমা মনোনয়নের স্ক্রুটিনি না করেই কীভাবে তা বৈধ বলে কমিশন মেনে নেবে?
প্রধান বিচারপতি বলেন, মূল প্রশ্ন, ই-মনোনয়ন গ্রহণযোগ্য কি না? নির্বাচনী নিয়মাবলীতে বদল না করেই তা করা যায় কি না? তথ্যপ্রযুক্তি আইন এক্ষেত্রে কার্যকর কি না?
সিপিএমের আইনজীবী অশোক ভান যুক্তি দেন, গোটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিরপেক্ষতার বালাই ছিল না। মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে বাধা পেয়েই ই-মেল করতে হয়েছে। প্রধান বিচারপতি যুক্তি দেন, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ভোটের পরেই প্রশ্ন তোলা যায়। ভোটপর্ব চলাকালীন কোনও সুরাহার রাস্তা নেই। বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় যুক্তি দেন, এক্ষেত্রে মনোনয়ন জমার তারিখও পেরিয়ে গিয়েছে। এই সময় আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
এরপরেই বিজেপির আইনজীবী পি এস পাটওয়ালিয়া যুক্তি দেন, ৫৮ হাজার আসনের মধ্যে ৩৪ শতাংশ আসনে বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারেনি। সেখানে শাসক দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে। কমিশনের আইনজীবী বলেন, ওই ৩৪ শতাংশ আসনের প্রার্থীরা কেউ আদালতে আসেননি। তার জন্য ১৪ মে-র ভোট কীভাবে আটকে রাখা যায়? প্রধান বিচারপতি জানিয়ে দেন, নির্বাচনে স্থগিতাদেশ হবে না।
ভোটপ্রক্রিয়া আইন মাফিক চলতে দেওয়ার কথা বললেও, ভোট নিয়ে সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেসকে তাদের বক্তব্য হলফনামা দিয়ে জানাতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট।