প্রতীকী ছবি
সারদা অর্থ লগ্নি সংস্থার মালিক সুদীপ্ত সেন কাশ্মীরের সোনমার্গ থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে। সে বছর স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে রাজ্যের ভাঁড়ারে পড়ে ছিল মাত্র ১২৫ কোটি টাকা। তার ঠিক আগের বছর ২০১১-১২’তে যখন এ রাজ্যে অর্থ লগ্নি সংস্থাগুলির রমরমা চলছে, তখন ডাকঘর ও ব্যাঙ্কে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে যা জমা পড়েছিল, তার চেয়ে বেশি টাকা তুলে নিয়েছিলেন আমানতকারীরা। ২০১২-এর মার্চে স্বল্প সঞ্চয়ের ‘ব্যালেন্স’ ছিল (-)৯৮৭ কোটি টাকা। ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সেই ভাঁড়ার-শূন্য দশা এখন অতীত। ফের স্বল্প সঞ্চয়ের স্বর্ণযুগে ফিরেছে বাংলা।
অর্থ মন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল সেভিংস ইন্সটিটিউট (এনএসআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-এর নভেম্বর পর্যন্ত স্বল্প সঞ্চয়ে রাজ্যের তহবিলে জমা ছিল ৫৮ হাজার কোটির বেশি। তার মধ্যে ১৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা নিট সঞ্চয়। কোনও এক বছরে মোট জমা থেকে আমানতকারীরা টাকা তুলে নেওয়ার পর যে টাকা পড়ে থাকে তাকেই বলে নিট সঞ্চয়। দেশের মধ্যে রাজ্য মোট সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে। নিট সঞ্চয়ের পরিমাণও এখন উপরের দিকে। চলতি বছরের শেষ চার মাসে মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ ৯০ হাজার কোটি ছাড়াতে পারে বলে মনে করছেন অর্থ কর্তারা।
তবে শুধু রাজ্য নয়, সারা দেশেই স্বল্প সঞ্চয়ে ফের এক দফা জোয়ার এসেছে বলে দাবি করেছেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। ২০১৮-এর নভেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট স্বল্প সঞ্চয় ছিল ৪ লাখ কোটির বেশি। এর মধ্যে নিট সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। আর্থিক বছর শেষ মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা অর্থ কর্তাদের। নিট সঞ্চয় বাবদও থাকতে পারে অন্তত দেড় লক্ষ কোটি। যা সামাজিক ক্ষেত্র ও পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করার জন্য ব্যবহার করার ভাবনা রয়েছে মন্ত্রকের। রাজ্যগুলিও তাদের নিট সঞ্চয়ের অর্ধেক ‘ঋণ’ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে পারে।
এক সময় ডাকঘর থেকে টাকা তুলে আমানতকারীদের বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থায় বিনিয়োগ করার প্রবণতা বেড়েছিল। এনএসআই-এর তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ সালে দেশে মোট স্বল্প সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি জমা পড়েছিল ডাকঘরের সেভিংস অ্যাকাউন্টে। এর পরে মেয়াদি প্রকল্প জমা পড়েছিল ৬১ হাজার কোটি। মাসিক সঞ্চয় ও রেকারিং ডিপোজিট প্রকল্পে জমা পড়েছিল ১ লাখ কোটি। আর পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চয় ছিল ৯২ হাজার কোটি। এ ছাড়া সিনিয়র সিটিজেন স্কিম, সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা ও কিসান বিকাশ পত্র প্রকল্পেও জমেছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি। কেবল মাত্র ভবিষ্যনিধি প্রকল্প (পিপিএফ) ছাড়া বাকিগুলির অধিকাংশ জমা পড়েছে ডাকঘরেই। পিপিএফের ক্ষেত্রে ১৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে জমার পরিমাণ ডাকঘরের চেয়ে বেশি। নবান্নের এক কর্তা জানান, এক সময় স্বল্প সঞ্চয়ের প্রায় পুরো টাকাটাই ধার নিয়ে রোজের খরচ চালাত রাজ্য। কিন্তু স্বল্প সঞ্চয় কমতে থাকায় বাজারি ঋণ নিয়েই সচল রয়েছে কোষাগার। ইদানীং ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ায় রাজ্যের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মানছেন নবান্নের কর্তারা।
আবার টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে কম পিপিএফ, প্রবীণদের সঞ্চয় প্রকল্প, মেয়াদি প্রকল্প এবং কিসান বিকাশ পত্রের ক্ষেত্রে। নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন, আমানতকারীরা টাকা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করলেই রাজ্যের লাভ। কারণ, নিট সঞ্চয়ের উপরই রাজ্য ‘ধার’ পেতে পারে। তাই পিপিএফ এবং মেয়াদি প্রকল্পে এ রাজ্যে যত বেশি বিনিয়োগ হবে, তত লাভ হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের।
দেশের সামগ্রিক ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান একেবারে উপরের সারিতে। দেশে এই প্রকল্পে যে পরিমাণ টাকা জমা পড়ে তার ৭৩ শতাংশ আসে ১০টি রাজ্য থেকে। সাত বছর আগেও যেখানে রাজ্যে আমানতের চেয়েও বেশি পরিমাণ টাকা তোলা হচ্ছিল, সেখানে এখন রাজ্যে মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে বাংলায় মেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ তুলনামূলক ভাবে কম হওয়ায় নিট সঞ্চয়ে মহারাষ্ট্র এগিয়ে রয়েছে বলে জানান কর্তারা। নবান্নের অবশ্য দাবি, ২০১৮-১৯ সালে মোট সঞ্চয় এবং টাকা তোলার পর ভাঁড়ারে পড়ে থাকা নিট সঞ্চয়েও রাজ্য প্রথমই হবে।