বাঁচার দৌড়। আগুনের খবর শুনে ছুটছেন রোগী কোলে পরিজন, নার্স, আয়া সকলেই।
আগুন লেগিচে গো...ছ্যুইটি এইসু....
ঝড়ের বেগে খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালের তিন তলায় তখন কালো ধোঁয়া। গোটা হাসপাতাল জুড়ে হইচই, আতঙ্ক, ছোটাছুটি।
শনিবার ভরদুপুরে বহরমপুর স্টেশন রোডে তখন রীতিমতো যানজট। মূহূর্তে কিছু লোকজন হাসপাতালে ঢুকে পড়লেন উদ্ধার কাজে। কয়েকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে যানজট সামলে নিয়ন্ত্রণ করলেন ভিড়। কেউ আবার রোগীদের আশ্বস্ত করে খুঁজে দিলেন ‘হারিয়ে যাওয়া’ আত্মীয়দের।
ওঁরা কারা? কেউ রিকশা কিংবা টোটো চালান। কেউ হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট খেতে খেতে আড্ডা দেন। কেউ আবার নিজের কাজ নিয়ে এসেছিলেন হাসপাতাল এলাকায়। কারও কোনও নির্দেশ, অনুরোধ ছাড়াই এ দিন ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওঁরাই। দিনভর নীরবে কাজ করে বুঝিয়ে দিলেন, এ শহর আজও পাশে দাঁড়াতে জানে। জানে, বিপদের সময় নিজের জীবন বাজি রেখেও অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে।
অজিত বাহাদুর। বয়স ৩৫। পায়ে সমস্যা থাকায় হাঁটতে কষ্ট হয়। তবুও রুজির টানে তিনি টোটো চালান। এ দিনও হাসপাতালের সামনে তিনি যাত্রীদের অপেক্ষায় ছিলেন। বেশ কয়েকজন যাত্রী তাঁর গাড়িতেও উঠে পড়েছিলেন। ঠিক তখনই তিনি জানতে পারেন হাসপাতালে আগুন লেগেছে। হাতজোড় করে যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেন।
তারপর টোটোকে গলির ভিতরে রেখে কোনও মতে ছুটতে ছুটতে তিনি যান হাসপাতালের ভিতরে। দিনভর তিনি হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে গিয়েছেন। রোগীদের আত্মীয়দের সন্ধান করা থেকে শুরু করে জিনিসপত্র দেখভাল করার মতো কাজ তিনি করে গিয়েছেন। যাঁদের জন্য এতকিছু তিনি তাঁদের কাউকেই চেনেন না।
অজিত বলছেন, ‘‘বিপদের সময় মানুষের পাশে দাঁড়াব না তো কী করব! চেনা-অচেনায় কী আসে যায়। ক’টা টাকা আজ না হয় কম রোজগার হল। কিন্তু অন্যের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগটুকু তো পেলাম।’’ বছর পঁচিশের অরূপ দে-র বাড়ি হাসপাতাল লাগোয়া স্বর্ণময়ী এলাকায়। খবর পেয়ে তিনিও ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন বাচ্চাদের তাড়াতাড়ি নীচে নামানো হচ্ছে। সেই কাজে তিনিও হাত লাগান। পরম মমতায় বাচ্চাদের কোলে নিয়ে তিনিও তাদের পৌঁছে দেন শিশু বিভাগে।
আতঙ্কের কান্না, রোগীকে বাইরে আনার চেষ্টা, অগ্নিদগ্ধ হাসপাতালের ঘর।
অরূপ বলছেন, ‘‘বিপদের সময় কে কখন ডাকবে সে অপেক্ষায় থাকলে চলে নাকি! এটা তো আমাদের হাসপাতাল। আমাদের শহরের হাসপাতাল। অনেক সময় হাসপাতালের বিরুদ্ধে আমাদের নানা অভিযোগ থাকে। তাই বলে বিপদের সময় সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে না পড়লে বিপদ আরও বাড়বে বই কমবে না।’’
বহরমপুরের তারক দে, শ্রীমন্ত মণ্ডল, মলয় রায়ের মতো আরও অন্তত কয়েকজন দিনভর রাস্তার যানজট সামলে গিয়েছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘সকলে মিলে ভিতরে ঢুকলে বাইরেটা কে দেখবে? দমকল বা অন্যান্য গাড়ি যাতে হাসপাতালে যাতায়াত করতে কোনও সমস্যা না হয় সেটা আমরা দেখেছি।’’
অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ডোমকলের মর্জিনা বিবি। এ দিন তিনিও ভয়ে উপর থেকে নীচে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলেন না বাড়ির লোকজনকে। সেই সময় দেবদূতের মতো ছুটে আসেন অজিত। তিনিই দায়িত্ব নিয়ে খুঁজে বের করেন মর্জিনার স্বামীকে।
মর্জিনা বলছেন, ‘‘লোকটার হাঁটতে কষ্ট হয়। তবুও আমার জন্য যে ভাবে হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে স্বামীকে খুঁজে এনে দিলেন তা কোনও দিন ভুলব না।’’ মর্জিনার স্বামীর কথায়, ‘‘আমরা গ্রামের মানুষ। এতদিন ভাবতাম, শহরের লোকজন শুধু নিজের কথাই ভাবে। আজ সেই ভুল ধারনাটা ভেঙে গেল।’’
জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ওই যুবকদের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। ওরা এই শহরের গর্ব।’’
সব ছবি: গৌতম প্রামাণিক ও সাফিউল্লা ইসলাম