তাঁর ‘মা’ ছিল, পরোয়া ছিল না কিছুর

এ হেন ভারতীকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ‘গল্প’। এখন কান পাতলে জেলার বিভিন্ন কোণ থেকে ভেসে আসছে তাঁর তুঘলকি মেজাজের সেই সব টুকরো টুকরো ছবি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:১২
Share:

পশ্চিম মেদিনীপুর যদি একটি দেশ হত, তা হলে হয়তো সেই দেশের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী বলা যেত তাঁকে।

Advertisement

কাঁসাই নদীর ঘাটে বাঘ আর গরুকে কার্যত একসঙ্গে জল খাইয়ে ছেড়েছিলেন তিনি। শাসক দলের জেলা সভাপতি, সভাধিপতি, জেলাশাসক— সবাইকে ছাপিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে কী ভাবে এক জন পুলিশ অফিসার উঠে আসতে পারেন, তা পশ্চিম মেদিনীপুরের ৬ বছরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হত।

এ হেন ভারতীকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ‘গল্প’। এখন কান পাতলে জেলার বিভিন্ন কোণ থেকে ভেসে আসছে তাঁর তুঘলকি মেজাজের সেই সব টুকরো টুকরো ছবি।

Advertisement

বিকেল পাঁচটায় নাকি শুরু হত তাঁর দফতর। চলত, কোনও কোনও দিন ভোর চারটে পর্যন্ত। নিজের দফতরের অফিসারদেরই ডেকে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসের বাইরে বসিয়ে রেখে তিনি নাকি আত্মশ্লাঘায় ভুগতেন। অভিযোগ, জেলার ছোট-মাঝারি-বড়— সব ধরনের ব্যবসায়ীদের ডাক পড়ত তাঁর দফতরে। ওই একই ছবি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরে ডাক পড়ত ভিতরে। এক অফিসারের কথায়, ‘‘বাইরে বসিয়ে রাখাটাই ছিল ম্যাডামের স্টাইল।’’

দু’টো আলাদা চিত্র ধরে তুললেন দু’জন। এক, মোহনপুরে সভা করে বেরোচ্ছেন মুকুল রায়। তখন তিনি তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। এক চিত্র সাংবাদিকের ক্যামেরা ঝলসে উঠল। মুকুলের পিছন থেকে বেরিয়ে এলেন ভারতী। তাঁরও দু’তিনটে ছবি উঠে গেল মুকুলের সঙ্গে। ম্যাডাম আঙুল তুলে পুলিশ অফিসারদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন, ক্যামেরার ছবি মুছে দিতে হবে। কেন এমন নির্দেশ, কেউ জানেন না। তুঘলকি সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার অর্থ আরও বড় শাস্তি।

দুই, পুজোর উদ্বোধনে জেলাশাসক, তৃণমূলের বিধায়ক, জেলা সভাপতি— সবাই হাজির। কিন্তু, প্রধান অতিথির আসন ফাঁকা। অলিখিত নিয়ম, সেখানে বসার অধিকার শুধু ম্যাডামেরই আছে। সন্ধ্যা সাতটায় উদ্বোধন হওয়ার কথা। কিন্তু ম্যাডামের দেখা নেই। ওই যে, তাঁর জন্য লোকে অপেক্ষা করছে, এটা ভাবতে ও দেখতে নাকি ভালবাসতেন তিনি। সুতরাং ফিতে রয়ে গেল ফিতের জায়গায়। রাজনৈতিক নেতারা ফিতের তলা দিয়ে মাথা নিচু করে মণ্ডপে ঢুকে ফুল দিলেন, বেরিয়ে এলেন। ভারতী এলেন রাত ন’টায়। ফিতে কেটে উদ্বোধন হল পুজোর।

অভিযোগ, তাঁর আমলে ধেড়ুয়া, লালগড়ের অবৈধ বালি খাদান থেকে বালি তুলে লরি ছুটত মেদিনীপুর শহরের বুক চিরেই। এমনকী, ম্যাডামের প্রশ্রয়ে শহরের রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাকি দাঁড় করানোও থাকত বালি বোঝাই লরি।

পছন্দের কিছু অফিসারকে নিয়ে তিনি ‘বাহিনী’ তৈরি করেছিলেন বলে অভিযোগ। সামান্যতম বিরোধিতার সাজা হিসেবে পুলিশ লাইনে বসিয়ে দেওয়া হত অফিসারদের। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের যখন-তখন অপমান করতেন জুনিয়ররা। অপছন্দের অফিসারকে রাত দু’টোর সময়ে ঘুম থেকে তুলে মামলার তদন্তের জন্য অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ারও অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।

অবৈধ বালি খাদান, সোনা-আলু-মদ ব্যবসায়ী এমনকী জুয়ার ঠেক— অভিযোগ, তাঁর ‘নেকনজর’ থেকে বাদ পড়েনি কিছুই। এক সময়ে জেলায় শাসক দলের কোন নেতা কলকে পাবেন, তা-ও নাকি তিনিই ঠিক করতেন। তখন অনেকে বলতেন, তিনি ‘মা’ চিনেছেন। তাই এত দাপট!

তাঁরাই আজ বলছেন, এত বড় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব এ রাজ্যে খুব কমই জন্মেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন