(বাঁ দিকে) সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারী (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
ছিলেন ৭৭ জন বিধায়ক। কিন্তু তাঁদের মধ্যে দু’জন সাংসদ থাকা অবস্থায় বিধানসভা নির্বাচনে জেতেন। রাজ্যে বিজেপির সরকার হচ্ছে না বুঝেই বিধায়কপদে ইস্তফা দেন। গোড়াতেই সংখ্যা নেমে গিয়েছিল ৭৫-এ। তার পরেও দফায় দফায় দল ছেড়েছেন আট বিধায়ক। প্রয়াত এক জন। আরও এক জন ইস্তফা দিয়েছেন ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে। প্রয়াণ বা ইস্তফাজনিত উপনির্বাচনগুলির একটিতেও বিজেপি জেতেনি। বিধায়কসংখ্যা এখন নেমে দাঁড়িয়েছে ৬৫-তে। কিন্তু তাঁদের নিয়েও কি বিজেপি ‘নিশ্চিন্ত’? পদ্মশিবির সূত্রের খবর, দলকে ভাবনায় রেখেছে আরও আট জনের গতিবিধি।
সোমবার হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী মণ্ডল বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। একে পরিষদীয় দলে ভাঙন, তায় আবার তাপসী পরিষদীয় দলের প্রধান শুভেন্দু অধিকারীর জেলার বিধায়ক। ‘উচ্ছ্বসিত’ তৃণমূল দাবি করছে, ভাঙন শুভেন্দুর ‘দুর্গে’। কিন্তু অস্বস্তির কাঁটা তার বাইরেও রয়েছে। তার আভাস রয়েছে উত্তরবঙ্গে। রয়েছে রাঢ়বঙ্গে। রয়েছে মতুয়া অঞ্চলেও।
উত্তরবঙ্গের এক বিজেপি বিধায়ক গত কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। তিনি কার্শিয়াঙের বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা। ভোটের আগে বিজেপি পাহাড়ের জন্য ‘বিশেষ মর্যাদা’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে বিষ্ণুপ্রসাদের দাবি। শুধু ‘বিশেষ মর্যাদা’ নয়, পাহাড়কে বাংলা থেকে আলাদা করে পৃথক রাজ্য তৈরি করা উচিত বলেও তিনি মনে করেন। তা নিয়ে বার বার তিনি প্রকাশ্যে মন্তব্যও করেছেন। দল সে সব বক্তব্য অনুমোদন না করায় বিষ্ণুপ্রসাদ দলের বিরুদ্ধেও তোপ দেগেছেন। প্রয়োজনে দল ছাড়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে কার্শিয়াঙের বিধায়কের বোঝাপড়া তলানিতে। তবে তিনি তৃণমূলে যাবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। কারণ, তৃণমূলও পৃথক রাজ্যের দাবি মানে না।
উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক সৌমেন রায় বিজেপি ছেড়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে ফেরেন। তবে সৌমেনের আসল ‘আনুগত্য’ বিজেপির প্রতি, না কোচবিহারের রাজবংশী নেতা অনন্ত মহারাজের প্রতি, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। বিজেপির একাংশের দাবি, অনন্ত মহারাজের সুপারিশেই ২০২১ সালে কালিয়াগঞ্জে সৌমেন টিকিট পান। অনন্ত বিজেপির প্রতি ‘রুষ্ট’ হলে সৌমেন তৃণমূলে চলে যান। আবার বিজেপি অনন্তকে রাজ্যসভায় পাঠাতেই সৌমেন ফিরে আসেন। ইদানীং আবার অনন্ত-বিজেপি টানাপড়েনের আভাস মিলছে। সৌমেনও সেই টানাপড়েনের ‘শরিক’ হবেন কি না, তা নজরে রাখছে বিজেপি।
বাদ নেই রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের জেলাও। দক্ষিণ দিনাজপুরের বিজেপিতে আপাতদৃষ্টিতে ‘শান্তিকল্যাণে’র আবহ। কিন্তু নবনির্বাচিত মণ্ডল সভাপতিদের তালিকা ঘোষিত হওয়ার পর জেলার এক বিজেপি বিধায়ক দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে হারানোর চক্রান্ত হয়েছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই বিধায়ক তৃণমূলে যেতে পারেন বলে বছরখানেক আগে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। এখন তিনি ‘হারানোর ষড়যন্ত্র’ জাতীয় কথাবার্তা বলতে শুরু করায় আবার ‘অস্বস্তি’ শুরু হয়েছে দলের অন্দরে।
রাজ্যের যে দুই জেলায় মতুয়া ভোট সবচেয়ে বেশি, সেই নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনাতেও কয়েক জন বিধায়ক বিজেপি নেতৃত্বকে অনেক দিন ধরে ‘চাপে’ রেখেছেন। এঁদের মধ্যে তিন জনকে নিয়ে লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির স্নায়ুর চাপ বেড়েছিল। তাঁদের মধ্যে দু’জনকে লোকসভা নির্বাচনে টিকিট দিয়ে কোনও ক্রমে দলবদল ঠেকানো হয় বলে বিজেপি সূত্রের দাবি। দু’জনেই হেরেছিলেন। কিন্তু ভোটের আগে তাঁরা দল ছেড়ে চলে গেলে সেই ধাক্কায় বিজেপি আরও দু’টি আসন হারাতে পারত বলে দলের একাংশ মনে করেন। লোকসভা ভোটের টিকিটের বিনিময়ে সেটা অন্তত সামলে দেওয়া গিয়েছিল। ওই অঞ্চলেরই আর এক বিধায়ক দিন দুয়েকের জন্য নিজের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। তাঁর পরিবার ওই এলাকার রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী। কিন্তু পরিবারের অবস্থানের উল্টো পথে হেঁটে তিনি তৃণমূলের দিকে পা বাড়িয়েছেন বলে লোকসভা নির্বাচনের সময় রটে গিয়েছিল। সেই সম্ভাবনা সামলাতে এক ‘ওজনদার’ নেতাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
রাঢ়বঙ্গ ঘেঁষা এলাকা থেকেও জনা দুয়েক বিধায়কের ‘বেসুর’ নিয়ে বিজেপির অন্দরে চর্চা চলছে। এক জন হুগলি-বাঁকুড়া সীমানা এলাকার নেতা। আগে বামপন্থী দলের বিধায়ক ছিলেন। অন্য জন আরও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে নির্বাচিত। ‘খ্যাতনামী’ তকমাধারী। প্রথম জন বিভিন্ন আলাপচারিতায় ইদানীং বলছেন, ‘‘বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস— কোনও দলই খারাপ নয়। দল কখনও খারাপ হয় না। দলের কিছু লোক খারাপ হতে পারে।’’ অন্য জন গোড়া থেকেই বিজেপিতে ‘অতৃপ্ত’। তিন স্তরের নির্বাচনে দল তাঁকে লড়িয়েছে। দু’টি স্তরে জিতেছেনও। কিন্তু নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ ভাল নয়। সেই জেলার সবচেয়ে বড় বিজেপি নেতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘আদায়-কাঁচকলায়’ বলেই সকলে জানেন। আড়ালে-আবডালে তাঁকে বিরূপ মন্তব্য করতেও শোনা গিয়েছে। প্রসঙ্গত, এই বিধায়ককে নিয়ে আগেও দলবদলের জল্পনা ছড়িয়েছিল।
বিজেপি এখন থেকেই ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করতে চায়। কিন্তু তাতে প্রথমেই ‘ধাক্কা’ লেগেছে হলদিয়ার তাপসীর দলত্যাগে। সেই আবহেই ওই আট বিধায়ককে নিয়ে খানিক ‘চাপে’ রয়েছে বিজেপি। তাঁদের গতিবিধিতেও তাই নজর রাখা হচ্ছে।