Durga Puja

পুজো উদ্বোধনের লিস্টেও উপস্থিতি বাড়াল বিজেপি

এক সময়ে দুর্গোৎসবের বাংলায় বিজেপি সে ভাবে কল্কে পেত না। বিজেপি নেতাদের পৃষ্ঠপোষণায় বড়সড় পুজো হচ্ছে— এমনটা অনুবীক্ষণ যন্ত্রে খুঁজতে হত। ২০১৭ সালের শারদোৎসবেও বিজেপিকে সে ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২০১৮ সালে কলকাতা ও শহরতলির অনেক জায়গাতেই ফিতে কাটতে দেখা গেল রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকে।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ২০:১৯
Share:

ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

মাস দুয়েক আগে কলকাতার জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ নিজেই ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন। মহরমের জন্য কেন পিছবে দু্র্গা বিসর্জন? অগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে অমিত শাহ এমন প্রশ্নই তুলেছিলেন মেয়ো রোডে দাঁড়িয়ে। বিজেপি সভাপতির উত্তুঙ্গ কণ্ঠস্বর বুঝিয়ে দিয়েছিল, বাঙালির দুর্গোৎসব-আবেগকে ছোঁয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিজেপি। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ কাটিয়ে বোঝা গেল, বিজেপি সে চেষ্টায় খানিকটা সফলই হয়েছে।

Advertisement

পুজো উদ্বোধনের দৌড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এগিয়ে এখনও। কিন্তু প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ফিতে-কাটিয়েদের তালিকায় বিজেপি নেতাদের নামও এ বার বেশ চোখে পড়ছে।

মহালয়ার বেশ কয়েক দিন আগেই এ বার উদ্বোধন হয়েছে শ্রীভূমি স্পোর্টিং-এর পুজোর। বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসুর পুজো, অতএব উদ্বোধকের নাম স্বাভাবিক ভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই থেকে শুরু। চতুর্থী পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে কাটা পড়া ফিতের সংখ্যা ৬০-এর আশেপাশে।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে প্রথম কয়েক বছর পুজো উদ্বোধক হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাহিদা ক্রমশ বেড়েছে। এই সব পুজো কমিটির মধ্যে অনেকগুলোই আবার তৃণমূলের মন্ত্রী-বিধায়ক-কাউন্সিলরদের পুজো হিসেবে পরিচিত। এ রাজ্যের রাজনীতিতে বাম বিরোধী শিবিরের নেতারাই মূলত পুজো উদ্যোগগুলির পৃষ্ঠপোষণা করেন। মহাধুমধামে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা তাঁদের জনসংযোগের অন্যতম অঙ্গও বটে। একডালিয়া এভারগ্রিন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের, নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের, সুরুচি সঙ্ঘ অরূপ বিশ্বাসের, চেতলা অগ্রণী ফিরহাদ হাকিমের, ত্রিধারা সম্মিলনী দেবাশিস কুমারের, শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব সুজিত বসুর, নলিন সরকার স্ট্রিট অতীন ঘোষের— এ ভাবেই পরিচিত কলকাতার একের পর এক নামী পুজো কমিটি। এ ছাড়াও সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাধন পাণ্ডে, শশী পাঁজা, মদন মিত্র, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়— বিভিন্ন পুজো কমিটির পৃষ্ঠপোষণায় থাকেন তৃণমূল নেতারা।

দুর্গোৎসবকে ঘিরে যে বিপুল জনসংযোগের সুযোগ হয়, তা আর কোনও উৎসবেই হয়ে ওঠে না এ বাংলায়। জনমনোরঞ্জন, প্রচারের আলো পাওয়া এবং নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিচয় দেওয়া— একসঙ্গে অনেকগুলো উদ্দেশ্য সাধন করে দেয় দুর্গাপুজো। তাই বাংলার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শিবিরে পুজোর উদ্যোগ এবং পুজোর আয়োজন নেতাদের খুব পছন্দের। কংগ্রেসের হাত ধরেই মূলত শুরু এই প্রবণতার। পরবর্তী কালে সেই নেতারাই দল বদলে তৃণমূলে গিয়েছেন। কিন্তু নিজের নিজের এলাকায় পুজোর রাশটা নিজেদের হাতেই রেখেছেন। আর কংগ্রেস ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে। কংগ্রেস নেতাদের পৃষ্ঠপোষণায় উল্লেখযোগ্য পুজো বলতে এখন কলেজ স্কোয়্যার। সোমেন মিত্রের পুজো হিসেবে খ্যাতি রয়েছে ওই পুজো কমিটির।

আরও পড়ুন: পুজোয় সুস্থ থাকুন, নিজেকে দূরে রাখুন এই সব ভুল ঘরোয়া পদ্ধতি থেকে

পুজো কমিটির গায়ে নিজেদের স্টিকার লাগানোর লড়াইয়ে কংগ্রেস পিছিয়ে পড়লেও, বিজেপি কিন্তু মাঠ ছাড়তে নারাজ। এক সময়ে দুর্গোৎসবের বাংলায় বিজেপি সে ভাবে কল্কে পেত না। বিজেপি নেতাদের পৃষ্ঠপোষণায় বড়সড় পুজো হচ্ছে— এমনটা অনুবীক্ষণ যন্ত্রে খুঁজতে হত। ২০১৭ সালের শারদোৎসবেও বিজেপিকে সে ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২০১৮ সালে কলকাতা ও শহরতলির অনেক জায়গাতেই ফিতে কাটতে দেখা গেল রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। নিজের বিধানসভা কেন্দ্র খড়্গপুরেও দিলীপকে দিয়ে ফিতে কাটানোর হিড়িক পড়ল এ বারের পুজোয়।

মহাপঞ্চমীর সকালে বিরাটি এলাকায় দুর্গোৎসবের উদ্বোধন করেন দিলীপ ঘোষ। দমদমের গোরাবাজার এলাকায় এক প্রাক্তন বিজেপি কাউন্সিলরের পুজোতেও এ দিন ফিতে কাটতে যান দিলীপ। মহাপঞ্চমীর বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার রংকল এলাকায় একটি পুজোর উদ্বোধন করেন তিনি। জোড়াবাগান এলাকায় একটি পুজো মণ্ডপের উদ্বোধনও দিলীপ ঘোষের হাতেই হয়েছে এ বার।

লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে মাসখানেক আগে থেকেই জেলায় জেলায় ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির শীর্ষনেতারা। ব্যস্ততার কারণে কিছুটা ভাগাভাগিও করে নেওয়া হয়েছে উদ্বোধনের তালিকা। রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুও বেশ কয়েকটা পুজোর উদ্বোধন করেছেন। গোরাবাজারে পুজোর উদ্বোধনে এ দিন সকালে দিলীপের পাশে সায়ন্তনও ছিলেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটের কাছে এ দিন বিকেলে একটি পুজোর উদ্বোধন করেন তিনি। সন্ধ্যায় বড়বাজার এলাকার তারাসুন্দরী পার্কের দুর্গোৎসবের উদ্বোধনও হয় সায়ন্তনের হাতে। বিজেপি সূত্রে তেমনই জানানো হয়েছে। মহাষষ্ঠীতে ঝাড়গ্রাম জেলার আমলাশোলে একটি পুজোর উদ্বোধনও করবেন সায়ন্তন বসুই।

রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বললেন, ‘‘কলকাতা আর জেলা মিলিয়ে আমি গোটা দশেক পুজো উদ্বোধন করছি। আর আমাদের রাজ্য সভাপতি শুধু কলকাতাতেই গোটা দশেক পুজোর উদ্বোধন করেছেন। নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে আরও অনেকগুলি উদ্বোধন তাঁর হাতেই হবে। সব মিলিয়ে দিলীপদা গোটা তিরিশেক পুজোর উদ্বোধন করছেন এ বার।’’

আরও পড়ুন: মাথার উপর থেকে সরল নিম্নচাপের মেঘ, রোদ ঝলমল পঞ্চমীতেই খোলতাই পুজোর মেজাজ!

এই হিসেব বলছে, রাজ্য বিজেপির প্রথম সারিতে থাকা নেতাদের হাতে উদ্বোধন হওয়া পুজোর সংখ্যা এ বার ৪০-এর মতো। গত বছর এই সংখ্যাটা অর্ধেকও ছিল না বলে বিজেপি সূত্রের খবর। অর্থাৎ পুজোকে কেন্দ্র করে জনসংযোগের যে মাঠ, তাতে তৃণমূলকে আর একচ্ছত্র থাকতে দিতে চাইছে না বিজেপি। কংগ্রেস এই চ্যালেঞ্জটা তৃণমূলের দিকে ছুড়তে পারেনি। আর সিপিএম সম্ভবত পার্টি লাইনের কারণে খুব জোর দিয়ে চেষ্টাই করেনি। কিন্তু পুজোকে কেন্দ্র করে জনসংযোগের চেষ্টা করায় কোনও বাধা নেই বিজেপির। নীতিগত বা আদর্শগত ভাবে কোনও সমস্যা নেই। দেশের শাসক দল হওয়ায় অর্থাভাবও খুব একটা নেই। সব কিছু মাথায় রেখেই পুজোর বাজারে নিজেদের ভাগ বুঝে নিতে ঝাঁপিয়েছিল বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টেক্কা দিতে তারা পারেনি। কিন্তু নিজেদের উপস্থিতিটা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা।

তৃণমূলের নেতারা প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ায় গুরুত্বই দিচ্ছেন না বিজেপি-কে। কিন্তু পুজো উদ্বোধন বা পুজোর আয়োজনের দৌড়ে বিজেপি-ও সামিল হওয়ায় রাজ্যের শাসক দলের ভ্রূ ঈষৎ কুঞ্চিত। তৃণমূল নেতারা বলছেন, যে সব পুজো কমিটির নামই কেউ জানেন না, বিজেপি নেতারা সেখানে গিয়ে ফিতে কাটছেন। কিন্তু চাপও যে একটা অনুভূত হচ্ছে অনেক দিন ধরেই, তা-ও কথায় কথায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র যেমন মাঝেমধ্যেই কথায় কথায় বলছেন, ‘‘বিজেপি এখন পুজো কিনছে। প্রচুর টাকা ছড়াচ্ছে আর খুঁজছে, কোন পুজো কমিটিকে কেনা যায়।’’ অর্থাৎ যে সব পুজো মণ্ডপের উদ্বোধন এ বার দিলীপ ঘোষ বা সায়ন্তন বসুদের হাতে হল, সেগুলোকে টাকা দিয়ে কিনেছে বিজেপি— মদন অনেকটা এমনই দাবি করছেন। আর বিজেপি পাল্টা প্রশ্ন তুলছে— তৃণমূলের নেতারা বা মন্ত্রীরা যে সব পুজোর উদ্যোক্তা, সেই সব কমিটির জন্য তাঁরা টাকা খরচ করেন না?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার বাইরে সে ভাবে পুজো উদ্বোধনে যাননি। কিন্তু বিজেপি নেতারা কলকাতার পাশাপাশি জেলার আমন্ত্রণগুলোও স্বীকার করেছেন। তাই শুধু কলকাতার পুজো পরিসরে বিজেপির প্রভাব বিচার করা হলে অনেক এগিয়ে রাখতে হবে তৃণমূলকে। কিন্তু কলকাতার বুকে বিজেপির পৃষ্ঠপোষণায় পুজোর আয়োজন যে আগের বছরের তুলনায় এ বছর বেশ খানিকটা বেশি, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই।

সায়ন্তনের কথায়, ‘‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের পার্টি বাড়ছে, প্রভাব বাড়ছে, শক্তি বাড়ছে। উদ্বোধনের সব আমন্ত্রণ আমরা নিতে পারিনি। পারলে বুঝতেন প্রভাবটা আরও বেশি।’’

(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার খবর এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলায় খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন