Suvendu Adhikari

চার বছরে আট বার তাঁর বিরুদ্ধে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব, চার বার সাসপেন্ড! বিধানসভায় বিরল রেকর্ডের ‘অধিকারী’ শুভেন্দু

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় শুভেন্দু ছাড়াও বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব সামলেছেন সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। তারাও বারকয়েক স্বাধিকার ভঙ্গ এবং নিলম্বনের মুখে পড়লেও, শুভেন্দুর মতো পরিস্থিতিতে কাউকে পড়তে হয়নি।

Advertisement

অমিত রায়

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৫ ১১:০৫
Share:

শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

বিধানসভার অধিবেশনে তাঁকে ‘লিমিটলেস অপোজিশন লিডার’ বলে বর্ণনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থাৎ, তিনি এমন এক বিরোধী দলনেতা, যাঁর মাত্রাজ্ঞান নেই।

Advertisement

হতে পারে। না-ও হতে পারে। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী মাত্রা চাড়িয়েছেন তাঁর বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থায়। ২০২১ সালে তিনি রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হয়েছিলেন (যে পদ পরিষদীয় রাজনীতিতে রাজ্যের মন্ত্রীর সমতুল)। তার পর থেকে গত চার বছরে তাঁর বিরুদ্ধে আট বার স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব এনেছে সরকার পক্ষ। চার বার তিনি সাসপেন্ড (নিলম্বিত) হয়েছেন বিধানসভার অধিবেশ থেকে।

শুভেন্দু অবশ্য তাতে দমছেন না। বরং বলছেন, ‘‘ওরা আমার কিছু করতে পারবে না। আমি মুখ্যমন্ত্রীকে নন্দীগ্রামে গত বিধানসভা ভোটে হারিয়েছি। আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও আবার হারাব। আমি একমাত্র বিধায়ক, যে ২০০৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও দিন সাংসদ বা বিধায়ক থাকাকালীন মেডিক্যাল বিল নেয়নি। আমি নিলম্বিত থাকার সময় বেতন নিইনি। স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব বা সাসপেনশন এনে আমায় বাংলার মানুষের কথা বলা থেকে রুখতে পারবে না এই সরকার।’’ তৃণমূল পরিষদীয় দল অবশ্য মনে করে না, শুভেন্দু শুধু বাংলার মানুষের কথা বলার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। শাসক শিবিরের পরিষদীয় দলের তরফে মুখ্যসচেতক নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘বিরোধী দলনেতা যে সব কথা গত কয়েক বছরে প্রকাশ্যে বলেছেন, তা একেবারেই সমর্থন করা যায় না। তাই বার বার সরকারের তরফে স্পিকারের কাছে আমরা আবেদন করেছি। সংসদীয় গণতন্ত্রের আমরা নীতিগত ভাবে প্রতিপক্ষ। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে নই। সেটা বিরোধী দলনেতাকে স্মরণ করিয়ে দিতেই আমরা প্রতিবাদ করে স্পিকারের কাছে গিয়েছি।’’

Advertisement

মঙ্গলবার বিধানসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা শুভেন্দুকে ‘লিমিটলেস’ বিশেষণ দিয়েছিলেন। শুভেন্দু বুধবার বিধানসভার বাইরে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে সেই মুখ্যমন্ত্রীকেই কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন। ঘটনাচক্রে, বুধবারই নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দুর বিরুদ্ধে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। গত চার বছরের মধ্যে এই নিয়ে অষ্টম বার। কখনও মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, কখনও তৃণমূল পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতক নির্মল ওই প্রস্তাব এনেছেন। ২০২১ সালে জুলাই মাসের বাদল অধিবেশনে প্রথম বার শুভেন্দুর বিরুদ্ধে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব আনা হয়েছিল। বিধানসভার বাইরে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দলদাস’ বলেছিলেন শুভেন্দু। তার প্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব আনে তৃণমূল পরিষদীয় দল। ওই বছরেই বিধানসভার বাজেট অধিবেশন তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের বক্তৃতা চলাকালীন গোলমাল পাকানোর অভিযোগে শুভেন্দু-সহ ছয় বিজেপি বিধায়ক নিলম্বিত হন। এর পরে কখনও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য, কখনও আবার অধিবেশনে অসংসদীয় আচরণের জন্য স্বাধিকারভঙ্গ বা নিলম্বনের মুখে পড়েছেন শুভেন্দু। ২০২২ সালে এক বার বিধানসভার অধিবেশনকক্ষেই তৃণমূল এবং বিজেপি বিধায়কেরা নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি এবং হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সে বারও শুভেন্দু নিলম্বিত হয়েছিলেন। সে বার তাঁর সঙ্গে একঝাঁক বিধায়কও নিলম্বিত হয়েছিলেন। একবার নিলম্বিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন শুভেন্দু। সে বার আদালতের মধ্যস্থতায় বিধানসভায় ফেরেন তিনি। তখন আট মাস তিনি বিধানসভা থেকে বেতন নেননি বলে দাবি বিরোধী দলনেতার।

বিধানসভা সচিবালয়ের সূত্র বলছে, ১৯৫৭ সাল থেকে বিধানসভার ইতিহাসে কখনও কোনও বিরোধী দলনেতাকে এত বার স্বাধিকারভঙ্গ এবং নিলম্বনের মুখে পড়তে হয়নি। মমতার জমানায় শুভেন্দু ছাড়াও বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব সামলেছেন সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। তাঁরাও বার কয়েক স্বাধিকারভঙ্গ এবং নিলম্বনের মুখে পড়লেও শুভেন্দুর মতো ‘রেকর্ড’ কারও নেই।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় বিরোধী দলনেতা থেকেছেন প্রয়াত জ্যোতি বসু। তিনি ১৯৫৭-’৬৭ এবং ১৯৭১-’৭২ সালে বিরোধী দলনেতা ছিলেন। এমন নজির তাঁর ঝুলিতেও নেই বলেই দাবি ওয়াকিবহাল প্রবীণদের। প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের কথায়, ‘‘এর আগে শুভেন্দুর মতো কোনও বিরোধী দলনেতাকে এতবার স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাবের মুখে পড়তে হয়নি বা নিলম্বিত হতে হয়নি। তবে এটাও ঠিক যে, আমিই একমাত্র বিরোধী দলনেতা, যাকে অধিবেশন চলাকালীন সভাকক্ষের মধ্যে শাসকদলের বিধায়কদের হাতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। এখন বিধানসভায় যাঁরা শাসকের বিরোধী পদে রয়েছেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, আমরা যেন পরস্পরকে আক্রমণের বিষয়ে শব্দের ব্যবহারে সংযত হই।’’

প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের দশকে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাবের কারণে হিরাপুরের (অধুনাবিলুপ্ত) কংগ্রেস বিধায়ক শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধায়ক পদ খারিজ হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ভুয়ো মেডিক্যাল বিল বিধানসভায় জমা দেওয়ার। পরে সেই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর বিধায়কপদ খারিজ হয়। লোকসভার স্বাধিকারভঙ্গ কমিটি ১৯৭৮ সালে জনতা সরকারের আমলে ইন্দিরা গান্ধীর রায়বরেলীর সাংসদপদ খারিজ করেছিল। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সেটিই সর্বোচ্চ শাস্তি বলে বিবেচিত হয়।

চলতি বিধানসভার মেয়াদ আরও প্রায় এক বছর রয়েছে। দেখার, সেই সময়কালে শুভেন্দু ‘লিমিটলেস’ থাকেন কি না। বা তাঁর শাস্তির ‘লিমিট’ তিনি কোথায় বাঁধেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement