রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য বাংলোর ভগ্নদশা

বর্তমানে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য এই বাংলো সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রপ্রেমীদের মধ্যে। ক্ষোভ আছে এলাকাবাসীরও। তাঁদের দাবি, সরকার বাংলোটি অধিগ্রহণ করে সংস্কার করুক এবং সেখানে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তুলুক।

Advertisement

সামসুল হুদা

গোসাবা শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৮ ০১:৪০
Share:

ভাঙাচোরা: ক্যানিংয়ে সেই বাংলো। নিজস্ব চিত্র

বিশ্বখ্যাত এক কবি, সত্তরটি বসন্ত পার করেও যাঁর অজানাকে জানার স্পৃহা বিন্দুমাত্র কমেনি। তাই অসুস্থ শরীরেই তিনি ছুটে গিয়েছেন প্রত্যন্ত সুন্দরবনে। এক সাহেবের আমন্ত্রণে। সাহেব সেখানে পল্লি উন্নয়নের কাজ করছেন। এ দিকে কবিও তো পল্লি উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে ভেবে চলেছেন। তাই তাঁর খুব ইচ্ছা, সেই কাজ সরেজমিন দেখে আসেন। সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তাঁর সুন্দরবন-যাত্রা।

Advertisement

কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সুন্দরবন-যাত্রার দিনটি ছিল ১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের আমন্ত্রণে গোসাবায় এসেছিলেন কবি। কবি শুনেছিলেন কৃষি, হস্তশিল্প, পশুপালন ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সুন্দরবনের এই এলাকার অর্থনীতিটাই পাল্টে দিয়েছেন স্কটল্যান্ডের এই সাহেব। তাঁর আতিথেয়তায় কবি উঠেছিলেন কাঠের তৈরি সুদৃশ্য ‘বেকন বাংলো’য়। কবির স্মৃতিবিজড়িত এই বেকন বাংলো সুন্দরবনে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে এখনও অন্যতম আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য।

কিন্তু বর্তমানে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য এই বাংলো সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রপ্রেমীদের মধ্যে। ক্ষোভ আছে এলাকাবাসীরও। তাঁদের দাবি, সরকার বাংলোটি অধিগ্রহণ করে সংস্কার করুক এবং সেখানে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তুলুক।

Advertisement

এ বিষয়ে বিশিষ্ট আবৃত্তিকার তথা রবীন্দ্র অনুরাগী দেবব্রত ঘোষাল ও নাট্যকার শিবানী ঘোষাল বলেন, ‘‘সুন্দরবনের মানুষের কাছে রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত বেকন বাংলো খুবই গর্বের বস্তু। পর্যটকদের কাছেও এর আকর্ষণ কম নয়। কিন্তু এখানে কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র ও বিভিন্ন নথিপত্র যা এককালে ছিল, তার আজ প্রায় কিছুই নেই। আমরা চাই, বাংলোটির সংস্কার হোক। বাংলোটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হোক।’’

১৯০৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে গোসাবা, রাঙাবেলিয়া ও সাতজেলিয়া লিজ নিয়ে একটি সমবায় গড়ে তুলেছিলেন হ্যামিল্টন। তিনি চেয়েছিলেন, প্রত্যন্ত সুন্দরবনের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হোক। এলাকার চাষিদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন কো-অপারেটিভ রাইস মিল। সেই মিলে চাষিরা সরাসরি তাঁদের জমির ধান নায্য দামে বিক্রি করতে পারতেন। আবার এই মিলে কাজ করেই তাঁরা আলাদা লভ্যাংশও পেতেন।

রবীন্দ্রনাথও শান্তিনিকেতনে সমবায় তৈরি করেছিলেন। সাহেবের ইয়ং বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটির কথা শুনে উৎসাহিত কবি তাই আমন্ত্রণ পেয়ে একেবারে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন গোসাবায়। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে তিনি আসেন ক্যানিং। সেখান থেকে সাহেবের স্টিমারে করে গোসাবা ঘাট। সেখানে বিদ্যা নদীর ধারে কাঠের তৈরি সুসজ্জিত বেকন বাংলোয় ওঠেন রাত্রিবাসের জন্য।

এ হেন বাংলোটির কাঠমো আজ ভেঙে পড়ছে। বাংলো-চত্বরে চরে বেড়াচ্ছে গরু-ছাগল। সন্ধ্যার পরে নেশাখোরদের আড্ডাও জমে ওঠে সেখানে। কয়েক বছর আগে প্রাক্তন সাংসদ তরুণ মণ্ডলের আর্থিক সাহায্যে বাংলো-চত্বরে একটি রবীন্দ্রমূর্তি বসানো হয়।

কিন্তু ওইটুকুই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাংলো রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই করা হয়নি। এলাকাবাসীর আক্ষেপ, প্রতি বছরই এসে ফিরে যাচ্ছে ২৫ বৈশাখ এবং ২২ শ্রাবণ। কিন্তু বাংলোর রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। কী ভাবে বাংলোটি অধিগ্রহণ করে সংস্কার করা যায়, তা আমরা দেখছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন