বহরমপুরের এফইউসি মাঠে তৃণমূলের সভার প্রস্তুতি। — নিজস্ব চিত্র।
প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রাস্তা থেকে বাস তুলে নিলে দুর্ভোগের কেমন ছবির জন্ম হয় বহরমপুর-সহ তামাম মুর্শিদাবাদ গত ১৬ নভেম্বর তা দেখেছে। কংগ্রেস এবং জেলা প্রশাসনের জোড়া কর্মসূচির গোরোয় সেই দুর্ভোগ-স্মৃতি এখনও তরতাজা। আজ, সপ্তাহের প্রথম দিনে বহরমপুরের এফইউসি ময়দানে শাসক দলের সভা উপলক্ষে জেলাবাসী সেই দৃশ্যেরই পুনর্জন্মের আশঙ্কা করছেন!
মুর্শিদাবাদের বাস মালিক সংগঠনের তরফে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, জেলার প্রায় সব বাস তো বটেই, ছোট গাড়ি মায় নৌকা পর্যন্ত তৃণমূলের সভার জন্যে ভাড়া করা হয়েছে। জেলা তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, এ দিনের সভায় লক্ষাধিক কর্মী-সমর্থক উপস্থিত হবেন। তাঁদের বহরমপুরের এফইউসি ময়দানে আনতে প্রায় ৮০০ বাস ভাড়া করা হয়েছে। জেলায় সাকুল্যে বাস চলে ছ’শো থেকে সাড়ে ছ’শো। ফলে বাকি বাসের জন্যে হাত পড়েছে পাশের জেলাগুলিতেও। বীরভূম, বর্ধমান, মালদহ ও নদিয়া— এই চারটি জেলা থেকে বাকি ছ’শো বাস ভাড়া করা হচ্ছে। তবে শুধু বাস নয়, ট্রেকার-অটো, লরির মতো প্রায় এক হাজার গাড়ি আগেই ভাড়া করা হয়েছে। বেলডাঙা, লালবাগ থেকে জলপথে কর্মীদের আনতে ১০০ নৌকার ব্যবস্থাও থাকছে।
পরিবহণ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়ে কেন যাত্রী সাধারণকে বারবার নাকাল হতে হবে, সেই প্রশ্নও উঠছে। ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে নিত্যযাত্রী, সব মহলেরই প্রশ্ন, ‘কবে শুধরোবেন রাজনীতির কারবারিরা?’ ‘অন্য কোনও উপায়ে কি রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া যায় না?’
গত ১৬ নভেম্বর।- ফাইল চিত্র।
পেশায় ব্যবসায়ী রমজান আলি জানালেন ১৬ নভেম্বর, কংগ্রেসের সভার দিনে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। কান্দির এই চানাচুর ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘বাজারে বাজারে ঘুরে ব্যবসা করি। অধীরবাবুর সভার দিন বাস, ছোট গাড়ি না পেয়ে ব্যবসাই লাটে উঠেছিল। গাড়ি ভাড়ায় যে টাকা খরচ হয়েছিল, তার গোটাটাই পকেট থেকে গিয়েছিল।’’ শাসক দলের সভায় বাস উঠে যাচ্ছে জেনে তিনি এ দিন ঘরে বসে থাকবেন বলে মনস্থ করেছেন। দুর্ভোগ স্মৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে কেউ বাড়তি সময় হাতে নিতে স্কুলে বেরোচ্ছেন, কেউবা বাসে-ট্রেকারে গিয়ে করতে হবে এমন কাজ আগেভাগে সেরে রাখছেন। কিন্তু, যাঁদের বেরোতেই হবে, তাঁরা রীতিমতো শঙ্কায়।
আজ বহরমপুরের এফইউসি মাঠে শাসক দলের সভায় থাকছেন রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী। ফিরহাদ হাকিম, চন্দ্রনাথ সিংহ, কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী ছাড়াও জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক তথা শুভেন্দু অধিকারীর সভায় থাকার কথা। একই সঙ্গে বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন, কার্যকরি সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল, একাধিক বিধায়ক এমনকী নদিয়ার জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত সভায় বক্তব্য রাখবেন। তৃণমূলের অন্দরের খবর, এই সভা প্রদেশ সভাপতির ১৬ নভেম্বরের জনসভার পাল্টা সভা। তবে প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতারা একে বিধানসভা ভোটের আগে সাংগঠনিক সভা বলেই ব্যাখ্যা করেছেন।
সভা যে কারণেই হোক না কেন, সপ্তাহের প্রথম দিনে সাধারণ মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলা কেন?
সদুত্তর এড়িয়ে শাসক দলের জেলা নেতারা বরং ‘আগাম ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার’ রাস্তায় হেঁটেছেন। কার্যকরি সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল বলেন, ‘‘জেলার রুট ফাঁকা করে বাস তুলে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি?’’ এ দিন গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, সে আশঙ্কা রয়েছে তাঁরও। জেলা তৃণমূলের সভাপতি মান্নান হোসেন আবার কয়েক ধাপ এগিয়ে বলছেন, ‘‘জেলার মানুষকে আগাম সতর্ক করেছি আমরা, যাতে খুব প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ যেন বহরমপুরে ব্যক্তিগত কাজে না আসেন।’’
জেলা তৃণমূলের তরফে জানানো হয়েছে, টেক্সটাইল কলেজ মোড়, গির্জার মোড়, সমবায়িকা ও রানিবাগান মোড়, বাসস্ট্যান্ড চত্বর— মোট পাঁচ জায়গায় বড় পর্দায় মঞ্চের ছবি নেতা-কর্মীদের বক্তৃতা সরাসরি দেখানো হবে। যাঁরা সভাস্থলের কাছকাছি পৌঁছতে পারবেন না, তাঁদের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন তাঁরা। একই সঙ্গে শাসক দলের নেতৃত্বের আস্ফালন: ‘সোমবার গোটা বহরমপুর তৃণমূলের দখলে চলে যাবে। অচল হয়ে পড়বে শহর।’
তা হলে শহর সচল রাখতে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন?
মুর্শিদাবাদ জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ দফতরের আধিকারিক চিরন্তন প্রামাণিক সত্যিই কোনও আশ্বাস-বাক্য শোনাতে পারেননি। তিনি শুধু ‘পর্যাপ্ত’ সরকারি বাস চালানোর আশ্বাস দিয়েছেন। আর, বেসরকারি বাস মালিক সংগঠনকে অনুরোধ করেছেন সভা শেষের আগে পরে পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে। যা শুনে জেলাবাসীর অনেকেই বলছেন, ১৬ নভেন্বরও তো একই আশ্বাস দিয়েছিল প্রশাসন। হাতে গোনা সরকারি বাস ছাড়া পথে আর কিছুরই দেখা মেলেনি। তাঁরা বলছেন, ‘আর কি, সেই চেনা দুর্ভোগই ভবিতব্য!’