শাসকের গাঁধীগিরি। সিপিএম নেতাদের হাতে তাঁদের কার্যালয়ের চাবি তুলে দিচ্ছেন তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত (বাঁ দিকে)। বৃহস্পতিবার ব্যারাকপুরে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
ভোটের ফল বেরোতেই রাজ্য জুড়ে বারবার হিংসা আর হানাহানির অভিযোগ উঠছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। প্রসূতির পেটে লাথি, কিশোরের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া, শিশুকে বাঁশ দিয়ে মার— এমন কত কী! বাদ যায়নি ব্যারাকপুরও। ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকেই একের পর এক সিপিএমের দলীয় কার্যালয় দখল আর মারধরের অভিযোগ উঠছিল।
কিন্তু বৃহস্পতিবার শাসক দলের ‘শান্তি অভিযান’ শুরু হল এই ব্যারাকপুর থেকেই।
তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের ফল প্রকাশের পরে বলেছিলেন, ‘‘কোনও হিংসাত্মক ঘটনা বরদাস্ত করা হবে না।’’ যদিও হিংসা তাতে থেমে থাকেনি। কিন্তু এ দিন ব্যারাকপুরে দ্বিতীয় বার জয়ী বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত ও ব্যারাকপুর পুরসভার চেয়ারম্যান উত্তম দাস-সহ তৃণমূল নেতাদের উদ্যোগে ‘শান্তি অভিযান’কে স্বাগত জানিয়েছেন সব পক্ষই। ১৪ নম্বর রেল গেটের কাছে এক সময়ে সিটু পরিচালিত অটো ইউনিয়নের অফিস দখল করে নিয়েছিল তৃণমূল। এ দিন সেই অফিসের তালা খুলে ফের সিপিএম নেতাদের হাতেই চাবি তুলে দেন শীলভদ্রবাবুরা। আশ্বাস দেন যে কোনও প্রতিকূলতায় পাশে থাকার। ব্যারাকপুরকে মডেল করে অন্য বিধানসভা এলাকাগুলিতেও এই ‘শান্তি অভিযান’ হবে বলে জানিয়েছেন আশপাশের বিধায়কেরা।
বাম আমলে প্রথমে এক টাইপিস্ট বসতেন ১৪ নম্বর রেল গেটের কাছে ওই ঘরটিতে। তৃণমূলের তরফে দাবি, সিপিএম নেতারাই পরে ঘরটি দখল করেছিলেন প্রভাব খাটিয়ে। তখন সেটি হয়েছিল সিটু পরিচালিত অটো ইউনিয়নের অফিস। ২০১১-তে রাজ্যে প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পরে অটো ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ আসে তৃণমূলের হাতে। ইউনিয়নের সভাপতি হন লালন পাসোয়ান। পরে ইউনিয়নের এই অফিসটিও তৃণমূল দখল করে নেয় বলে অভিযোগ। তবে তৃণমূল দখল করলেও বেশির ভাগ সময়েই তালা বন্ধ অবস্থায় থাকত ঘরটি। অভিযোগ উঠেছে, এ বারের নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে তৃণমূল এ ভাবেই সিপিএমের দলীয় কয়েকটি কার্যালয় দখল করেছে।
ব্যারাকপুর স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাছে সিপিএমের একটি পুরনো কার্যালয়কেও জোর করে একটি ক্লাবের নামে লিখিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তপন রায় নামে স্থানীয় সিপিএম নেতার অভিযোগ, ‘‘দিন সাতেক আগেই আমার বাড়িতে চড়াও হয়ে জোর করা হয় পার্টি অফিসটি ক্লাবের নামে লিখে দেওয়ার জন্য। বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের কয়েক জন। বাধ্য হয়ে ওদের বলা বয়ান অনুযায়ী লিখে দিয়েছিলাম।’’ প্রসঙ্গত, প্রায় চল্লিশ বছর আগে ‘প্রতিভূ’ নামে একটি নাটকের দলের মহড়ার ঘর ছিল সিপিএমের ওই কার্যালয়। এখন ফের সেখানে নাট্যচর্চার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূল কর্মীরা। স্টেশনের কাছে সিপিএমের আর একটি দলীয় কার্যালয়ও তৃণমূল দখলের চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ ১৪ নম্বর রেলগেটের কাছের ওই ঘরটিতে ভিড় করেন বাম ও তৃণমূল কর্মীরা। বিধায়ক, চেয়ারম্যান ও অন্য তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন সিপিএমের প্রাক্তন পুরপ্রধান বিজলী মিত্র, সুব্রত সেনগুপ্ত, শক্তি মিত্র। তৃণমূল নেতারা আশ্বাস দেন পাশে থাকার। এর পরে ওই কার্যালয়ের চাবি তুলে দেওয়া হয় বিজলীবাবুদের হাতে। বিজলীবাবু বলেন, ‘‘এই শান্তি ও সম্প্রীতির সম্পর্ক সব সময়েই কাম্য। তবে আতঙ্কের জেরে আমাদের কয়েকটি কার্যালয় বন্ধ রাখতে হয়েছে। দখলও হয়ে গিয়েছে কয়েকটি। অনেকে এখনও ঘরছাড়া। সেগুলি আমরা বিধায়ককে জানিয়েছি।’’ এ প্রসঙ্গে শীলভদ্রবাবু বলেন, ‘‘ঘরছাড়ারা ঘরে ফিরুন। নিরাপদেই থাকবেন তাঁরা।’’
সব ভালয় ভালয় মিটে যাওয়ার পরে শীলভদ্রবাবু জানান, দলনেত্রীর নির্দেশেই এই ‘শান্তি অভিযান’ শুরু হল। তাঁর আশ্বাস, ‘‘যেখান থেকেই কোনও অভিযোগ পাব, সেখানে আমরা পদক্ষেপ করব। বিরোধী রাজনীতির মানুষ হলেও তাঁরা আমাদেরই বন্ধু-স্বজন।’’