সিবিআইয়ের নজরে এ বার নবান্নের দাপুটে অফিসারও

সারদা-কাণ্ডের তদন্তে বিধাননগর পুলিশের দুই শীর্ষকর্তার পাশাপাশি নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষস্তরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক প্রভাবশালী অফিসারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই। সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়ার আগে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছিল রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। সিবিআই তদন্তভার হাতে পাওয়ার পরে কিছু দূর এগোলেও তাদের অভিযোগ, এই মামলায় সিট-এর হাতে থাকা অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি বারবার চেয়েও হাতে পায়নি তারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৪ ০৩:১৮
Share:

সারদা-কাণ্ডের তদন্তে বিধাননগর পুলিশের দুই শীর্ষকর্তার পাশাপাশি নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষস্তরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক প্রভাবশালী অফিসারকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়ার আগে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছিল রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)। সিবিআই তদন্তভার হাতে পাওয়ার পরে কিছু দূর এগোলেও তাদের অভিযোগ, এই মামলায় সিট-এর হাতে থাকা অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি বারবার চেয়েও হাতে পায়নি তারা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য পুলিশকে চরমসীমা দিয়ে সিবিআই জানিয়েছে, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ওই সব নথি ও তথ্য তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। না হলে সিট-এর বিরুদ্ধে তথ্য নষ্ট ও গোপন করার অভিযোগ এনে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হবে তারা।

সিবিআই আগামী শনিবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অন্যতম কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুকে জেরা করবে। সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে সুদীপ্ত সেন অভিযোগ করেছিলেন, সেবি-তে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে দেবব্রত তাঁকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে বহু টাকা নিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই দেবব্রতকে তলব করেছে সিবিআই। একটি বাংলা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর কী চুক্তি হয়েছিল এবং তাতে ব্যবসায়ী রমেশ গাঁধীর কী ভূমিকা ছিল, সেই কাগজপত্রও জোগাড় করছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।

Advertisement

কিন্তু নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের প্রভাবশালী অফিসার ও পুলিশের শীর্ষকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের কারণ কী? সিবিআই-এর একটি সূত্রের কথায়, “রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক স্তর থেকে সিট-এর তদন্তে কোনও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা হয়েছিল কি না, হলেও কী ধরনের প্রভাব খাটানো হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতেই ওঁদের জেরা করা হবে। সেই সূত্র ধরেই পরে রাজ্যের মন্ত্রী ও শাসক দলের কিছু নেতাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

কোন কোন পুলিশকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে সে ব্যাপারে সিবিআই কিছু জানাতে রাজি হয়নি। তবে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত অনেকে মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্ট সারদা মামলা সিবিআই-কে দেওয়ার আগে বিধাননগর পুলিশের যে দুই শীর্ষ কর্তা ওই তদন্তের কাজ দেখভাল করছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কথা বলাটা স্বাভাবিক।

তবে সিবিআই সূত্রে এ-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে যে, রাজ্য প্রশাসনের ওই উচ্চপদস্থ কর্তা ও দুই পুলিশ-কর্তাকে অভিযুক্ত হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু সুদীপ্তর সারদা-গোষ্ঠীর প্রতারণার ব্যবসার ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল, তা ওই উচ্চপদস্থ কর্তার কাছে জানতে চাওয়া হবে। একই ভাবে তদন্তের সময় রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল, তা-ও ওই দুই পুলিশ-কর্তার কাছে জানতে চাওয়া হবে।

রাজ্য পুলিশের সিট সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত নিরপেক্ষ ভাবে করছে না বলে অসংখ্য বার অভিযোগ উঠেছে। তার ভিত্তিতেই সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলায় সিবিআই-কে তদন্তের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলতে ছাড়েননি। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে একাধিক তদন্তের ক্ষেত্রে সিবিআই রাজনৈতিক স্বার্থ দেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে শীর্ষ আদালত ভর্ৎসনাও করেছে তাদের। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের তরফে সিবিআই প্রধান রঞ্জিৎ সিংহকে বলা হয়েছে, সারদা তদন্তে সিবিআই যেন কোনও রাজনৈতিক স্বার্থ না দেখে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহও সংসদে বলেছেন, “প্রাথমিক স্তরে হলেও সিবিআইয়ের তদন্ত দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে।”

সিবিআই অবশ্য তদন্তের অগ্রগতিতে বিশেষ খুশি নয়। তদন্তকারীদের একাংশের সন্দেহ, রাজনৈতিক চাপের মুখে বিধাননগরের দুই পুলিশ-কর্তার নেতৃত্বে সিট সারদা-কাণ্ডের বহু তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে বিধাননগর পুলিশ যে ভাবে তথ্যপ্রমাণ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করছে, তাতে এই সন্দেহ বেড়েছে। এর আগে আর এক কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-ও সিট-এর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনেছিল।

সিবিআইয়ের বক্তব্য, সারদা মামলার কেস ফাইল, এফআইআর-এর কপি, আটক করা জিনিসপত্রের একটি তালিকা সিট তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। কিন্তু সুদীপ্ত ও অন্য অভিযুক্তদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ নথি এখনও হাতে পায়নি তারা।

কী কী তথ্যপ্রমাণ সিবিআই এখনও হাতে পায়নি?

গত শুক্রবার পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী, সারদা তদন্তে মোট ৬৪ জন সাক্ষীকে জেরা করেছে সিবিআই। সূত্রের দাবি, জেরায় সারদার তিন হিসেবরক্ষক স্বীকার করেছেন, প্রভাবশালী কয়েক জন রাজনৈতিক নেতাকে নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী তহবিলেও নগদে প্রায় ৩০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন সারদা কর্তা। সিবিআইকে ওই হিসেবরক্ষকরা জানিয়েছেন, ওই লেনদেনের হিসেব ও ভাউচার সিট বাজেয়াপ্ত করেছিল। কিন্তু সে সব তথ্য এখনও হাতে পায়নি সিবিআই।

সারদার কয়েক জন গাড়ি-চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই জেনেছে, বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দামি গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন। যেগুলির অধিকাংশই নগদ টাকায় কেনা হয়। সিট সেই সব নথি বাজেয়াপ্ত করলেও এখনও সে সব হাতে পায়নি সিবিআই। সারদার কর্মচারীরা জানিয়েছেন, সল্টলেকের ডিএন ব্লক ও মিডল্যান্ড পার্কের অফিস থেকে থেকে প্রায় শ’খানেক কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক, পেন ড্রাইভ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। সেখান থেকে পাওয়া কোনও তথ্যও এখনও হাতে পাননি বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।

সুদীপ্ত-সহ সারদা-কাণ্ডের মূল ছয় অভিযুক্তকে সিবিআই নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করেছিল। সুদীপ্ত, দেবযানী মুখোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষরা সেই জেরায় জানিয়েছেন, মিডিয়া ব্যবসার মাধ্যমে কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন। তা মিডিয়া ব্যবসার খাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ওই খাতা বাজেয়াপ্তও করেছিল সিট। যদিও সে সব তথ্য বা নথি এখনও হাতে পায়নি সিবিআই।

একই ভাবে গত ২২ এপ্রিল বিধাননগর পুলিশ যে ভাবে সারদা কর্তার স্ত্রী পিয়ালি সেনের একটি লকার খোলার জন্য বেশি রাতে ব্যাঙ্কে গিয়েছিল, তাতে সন্দেহ বেড়েছে গোয়েন্দাদের। এক গোয়েন্দা কর্তার বক্তব্য, সম্ভবত ওখানে এমন কোনও নথি ছিল, যা অনেক নেতাকে বিপদে ফেলতে পারত। ওই সব নথি যাতে ইডি বা কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে না পড়ে, সে জন্যই ওই ভাবে গভীর রাতে ব্যাঙ্কে গিয়ে লকার খুলেছিলেন সিট-এর তদন্তকারীরা।

সিবিআইয়ের কলকাতা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার ছাড়াও এক জন চিত্রশিল্পী, তিন জন ব্যবসায়ী, একটি পুরসভার চেয়ারপার্সন, রাজ্যসভার দুই তৃণমূল সাংসদ, দুই প্রাক্তন পুলিশ কর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। দেবব্রতবাবু আজ বলেন, “সিবিআই-এর তরফে ক্লাবের সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ক্লাবের সঙ্গে সারদার কী চুক্তি হয়েছিল, সে সব কাগজপত্র চেয়ে পাঠিয়েছে তারা। আগামী শনিবার আমি এবং ক্লাবের ক্রিকেট সচিব সিবিআই দফতরে যাব।”

সুদীপ্তর একটি বাংলা সংবাদ চ্যানেল কেনার বিষয়ে সিবিআই ব্যবসায়ী রমেশ গাঁধীর থেকে নথি সংগ্রহ করেছে। রমেশ গাঁধী বলেন, “বুধবারই সিবিআইয়ের একটি দল এসেছিল। সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের চুক্তি ও লেনদেনের কাগজপত্র তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কিন্তু ডেকে পাঠালে যেতে আপত্তি নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন