মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে নিতিন গডকড়ী, রাজনাথ সিংহ এবং বেঙ্কাইয়ানায়ডু। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রথম রাজ্য সফরে আসছেন নরেন্দ্র মোদী। তার চার দিন আগে নবান্নের কাছে বর্ধমান জেলায় রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি চেয়ে পাঠাল প্রধানমন্ত্রী দফতর। এই জেলার বার্নপুরেও যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে আধুনিকীকরণের পরে নব কলেবরের ইস্কো কারখানারটির উদ্বোধন করার কথা তাঁর। ঠিক তার আগে বার্নপুর ও সংলগ্ন এলাকা তো বটেই, সামগ্রিক বর্ধমানের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও জানতে চাইল দিল্লি। নবান্নের খবর, মঙ্গলবার বিকেলেই তথ্য-সহযোগে রিপোর্ট যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বার্নপুরে যেখানে প্রধানমন্ত্রী সভা করবেন, সেটা তাঁর দলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। লোকসভার ভোটে প্রচারে এসে এখানে দাঁড়িয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘মুঝে বাবুল চাহিয়ে।’। ফলে রাজনৈতিক ভাবে এই এলাকা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আসার আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এই তথ্য চেয়ে পাঠানোর মধ্যে তাই তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ। নবান্ন এর মধ্যে রিপোর্ট পাঠিয়েও দিয়েছে। তবে নির্দিষ্ট ভাবে এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা নিয়ে দ্বিমত রাজ্য প্রশাসনিক মহল।
প্রশাসনের একাংশ মনে করছে, রাজ্য সফরের আগে এখানকার সব কিছু সম্পর্কে বিশদে জেনেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান প্রধানমন্ত্রী। কোথাও যাওয়ার আগে ‘হোম ওয়ার্ক’ করে যাওয়াটাই মোদীর অভ্যাস। সে ভিন রাজ্যই হোক বা বিদেশ। নবান্নের এক কর্তা জানান, এই তথ্য হাতে থাকলে রাজ্যের জন্য কেন্দ্র কতটা সহায়তা দিতে পারে— মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার টেবিলেই তা জানাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রশাসনেরই অন্য অংশের মত, রাজ্যের উন্নয়নে কেন্দ্রের অসহযোগিতা নিয়ে যে প্রচার চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দল, তা কত দূর সঙ্গত— রাজ্যের দেওয়া রিপোর্ট থেকেই তা বুঝে নিতে চান প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি, দেখে নিতে চান নিজেদের উদ্যোগে রাজ্যই বা উন্নয়নের কাজ কতটা করছে।
বস্তুত, মোদীর সফরে তাঁর সঙ্গে দু’টি অনুষ্ঠানে মঞ্চে থাকলেও নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে পুরনো অবস্থান থেকে যে সরছেন না, সেটা আরও এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন শিলিগুড়িতে উত্তরকন্যায় সাংবাদিকদের তিনি জানান, মোদী কলকাতায় এলে রাজ্যের দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে তাঁর সরকার। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নজরুল মঞ্চ ও ইস্কোর অনুষ্ঠানে তিনি থাকবেন, এই ইঙ্গিত দিয়ে মমতার আরও বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যদি সময় দেন তা হলে আমি, অর্থমন্ত্রী, মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব তাঁর সঙ্গে আলাদা করে দাবিদাওয়া নিয়ে বসব।’’
কেন্দ্রের প্রতি কী তাঁদের অভিযোগ, সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মমতা বলেন, ‘‘দার্জিলিং, জঙ্গলমহলের টাকা বন্ধ। এগারোটি পিছিয়ে পড়া জেলায় টাকা আসছে না। ১০০ দিনের কাজ, মিড-ডে-মিল, পুলিশের আধুনিকীকরণ, অঙ্গনওয়াড়ি, সর্বশিক্ষার মতো নানা প্রকল্পে কোথাও কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনও কোনও প্রকল্প বন্ধ করা হয়েছে।’’ একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, রাজ্য থেকে আদায় হওয়া কেন্দ্রীয় করের বরাদ্দ ৩৬ থেকে বাড়িয়ে ৪২ শতাংশ করা হলেও অধিকাংশ প্রকল্পের ৯৯ শতাংশ অর্থ কেটে নেওয়া হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের একাংশ অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। তাঁদের বক্তব্য, এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটে আটটি প্রকল্প যেমন বন্ধ করা হয়েছে, তেমনই ১০-১২টিতে বরাদ্দ অনেকটা বাড়ানোও হয়েছে। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের বিশেষ হেরফের হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর কিন্তু এই দাবিদাওয়া এবং অভিযোগের একটা ঝলক পাবে রাজ্যের পাঠানো রিপোর্টে। সে সঙ্গে পাবে রাজ্য কী করেছে, তার ফিরিস্তিও। কী জানতে চেয়েছে কেন্দ্র? নবান্নের এক কর্তা জানান, রাজ্যকে নীতি আয়োগের মাধ্যমে এক বার্তা পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর দফতর। সেখানে রাজ্যের অধিগৃহীত সংস্থাগুলির আর্থিক অবস্থা, তার সংস্কার, নতুন বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বর্ধমান জেলার আর্থ-সামাজিক অবস্থান, সেখানে চলা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, সরকারের নতুন উদ্যোগ সম্পর্কেও জানতে চায় প্রধানমন্ত্রীর দফতর। এমনকী, ইস্কোর আশপাশের এলাকা নিয়েও বিশদে তথ্য চাওয়া হয়। নবান্নের খবর, জবাবে জেলা সংক্রান্ত সব তথ্য জানিয়ে জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন ২৪ পাতার রিপোর্ট পাঠান। তাতে আসানসোলের খনি এলাকার তো বটেই, সেই সঙ্গে কৃষি এলাকার নানা সমস্যার কথা জানিয়েছে। বর্ধমানকে বলা হয় বাংলার শস্য ভাণ্ডার। অথচ এই জেলায় কৃষিপণ্যের বাজার সে ভাবে তৈরি না হওয়ায় কী ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন চাষিরা, জানানো হয়েছে ওই রিপোর্টে। খনি দুর্ঘটনা-সহ নানা বিপর্যয়ে কী ভাবে বিপন্ন হচ্ছে মানুষ, দেওয়া হয়েছে সেই তথ্যও। খুটিনাটি তথ্য জানাতে গিয়ে বার্নপুর, আসানসোল এবং দুর্গাপুরের পানীয় জল ও আর্সেনিক দূষণ নিয়ে এলাকার দীর্ঘদিনের সমস্যার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। অধিগৃহীত সংস্থার সংস্কার নিয়েও তথ্য হয়েছে কেন্দ্রকে। সেখানে সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত বিবৃতির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আরও কিছু কৃতিত্বের দাবি। যেমন, পরিবহণ সংস্থাগুলিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে সংস্থাগুলির হাতে থাকা বাড়তি জমি বিক্রি করে নতুন লগ্নি টানার উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টে।
জেলার উন্নতির ফিরিস্তি রয়েছে জেলাশাসকের রিপোর্টে। বলা হয়েছে, আসানসোল-দুর্গাপুরকে দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম মেডিক্যাল হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল, ইঞ্জিনিয়ারিং-সহ নানা পেশাদারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। শিল্প পরিকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে রাজ্যের ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্কের’ কথাও। যদিও এই ল্যান্ড ব্যাঙ্কের বাস্তবতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে প্রশাসনের একাংশের মধ্যেই।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘‘ইস্কোর জন্য বিনা পয়সায় চার হাজার একর জমি দিয়েছে রাজ্য সরকার।’’ যদিও ওই কারখানার জনসংযোগ আধিকারিক ভাস্কর কুমার বলেছেন, ‘‘আধুনিকীকরণ প্রকল্পের জন্য ৯৬৫ একর জমি নতুন করে কিনতে হয়েছে। এ জন্য রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরকে ৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দিয়েছে ইস্কো। জমিদাতারা সকলেই ক্ষতিপূরণের টাকাও পেয়ে গিয়েছেন।’’ ২০০৬-এর ২৪ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এই আধুনিকীকরণ প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন। ২০০৭-এ জমি কেনার কাজ শুরু হয়। কুইলাপুর, নাকড়াসোতা ও শ্যামডিহি মৌজা থেকে জমি নেওয়া হয়েছে। ইস্কো সূত্রের খবর, প্রথমে আধুনিকীকরণের খরচ ধরা হয়েছিল ১৪ হাজার কোটি টাকা। সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার কোটি টাকায়।