নির্মল মাজির মদতে টোকাটুকি মেডিক্যালে

যাঁরা পরীক্ষা দিচ্ছিলেন, তাঁরা হবু ডাক্তার। যাঁরা সাদা অ্যাপ্রন পরে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা জুনিয়র ডাক্তার। পরীক্ষা-বৈতরণী পার করিয়ে দিতে হবে তো! শুরুটা দিব্যি জমে উঠেছিল। কিন্তু ছন্দপতন ঘটালেন আর এক দল জুনিয়র ডাক্তারই। টুকতে বাধা দেওয়া শুধু নয়, রীতিমতো মারধর করে গলাধাক্কা দিয়ে অপর পক্ষকে বের করে দিলেন তাঁরা।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫২
Share:

যাঁরা পরীক্ষা দিচ্ছিলেন, তাঁরা হবু ডাক্তার। যাঁরা সাদা অ্যাপ্রন পরে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা জুনিয়র ডাক্তার। পরীক্ষা-বৈতরণী পার করিয়ে দিতে হবে তো!

Advertisement

শুরুটা দিব্যি জমে উঠেছিল। কিন্তু ছন্দপতন ঘটালেন আর এক দল জুনিয়র ডাক্তারই। টুকতে বাধা দেওয়া শুধু নয়, রীতিমতো মারধর করে গলাধাক্কা দিয়ে অপর পক্ষকে বের করে দিলেন তাঁরা।

ঘটনাস্থল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। বিবদমান দু’পক্ষই শাসক দল সমর্থিত ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য বলে দাবি। দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছেন। এবং নেপথ্যের কারিগর হিসেবে যাঁর নাম এ বারেও উঠে এসেছে, তিনি ওই কলেজেরই রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান। তৃণমূল বিধায়ক, তথা চিকিৎসক-নেতা নির্মল মাজি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, এসএসকেএম থেকে এক দল জুনিয়র ডাক্তারকে মেডিক্যাল কলেজে এনে কেপিসি মেডিক্যালের কিছু পড়ুয়াকে এমবিবিএস থার্ড প্রফেশনালের মেডিসিন পরীক্ষায় ‘সাহায্য’ করাচ্ছিলেন তিনি। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে নির্মলের দাবি, অযথা তাঁর নামে কুৎসা রটানো হচ্ছে।

Advertisement

কিন্তু মঙ্গলবারের এই ঘটনার রেশ ছড়িয়েছে বহু দূর। স্বাস্থ্যভবন, এমনকী স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শোরগোল পড়ে গিয়েছে। রাজ্যে মেডিক্যাল শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, এই ঘটনায় আবারও তা বেআব্রু হল বলে মনে করছেন অনেকেই। কিছু দিন আগে নিজের ছেলের এমবিবিএস পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষাকেন্দ্রের সমস্ত সিসিটিভি বন্ধ রাখার আবদার করে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন নির্মলবাবু। স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, সেই সময়ে নির্মলবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই তাঁর ‘সাহস’ বেড়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা কিংবা রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা অবশ্য এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এমবিবিএস থার্ড প্রফেশনাল পরীক্ষায় এ বার যাদবপুর কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের সিট পড়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেই এমন ধুন্ধুমার বেধেছে। কেপিসি-র অধ্যক্ষ বরুণ সাহা দালাল বলছেন, ‘‘ঘটনার দায় তো মেডিক্যাল কলেজের। তারা কেন আটকাতে পারছে না? আমাদের এখানেও তো অন্য মেডিক্যাল কলেজের সিট পড়েছে। আমরা তো এই অনিয়ম বরদাস্ত করিনি।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তপন লাহিড়ির দাবি, তিনিও অনিয়ম বরদাস্ত করেননি। ‘‘মাথা খারাপ নাকি? আমি এমন প্রস্তাবে সটান ‘না’ বলে দিয়েছি।’’ তার মানে, টোকাটুকিতে সাহায্য করার প্রস্তাব যে এসেছিল সেটা প্রকারান্তরে মেনেই নিলেন তপনবাবু। মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, তপনবাবু রাজি না হওয়াতেই নির্মল মাজি নিজে আসরে নামেন। টানা দু’দিন দফায় দফায় মেডিক্যালে এসে তাঁকে পরীক্ষা ‘তদারকি’ করতে দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। এ বার নির্মল-ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু ডাক্তারের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় বসেছ‌েন বলে খবর। তাঁদের সাহায্য করতেই নাকি এই উদ্যোগ। নির্মলের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘আমি কিছু বললেই তা বিকৃত করা হবে। তাই না বলাই ভাল।’’

মেডিসিনের পরীক্ষা ছিল পরপর দু’দিন। সূত্রের খবর, মঙ্গলবার প্রথম পত্রের পরীক্ষা শুরু হওয়ার পরেই এসএসকেএম থেকে পাঁচ-ছ’জন জুনিয়র ডাক্তার সটান পরীক্ষার হল-এ ঢুকে যান। কয়েক জন পরীক্ষার্থীর প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর বলে দিতে শুরু করেন তাঁরা। সেই সময় মেডিক্যালের শিক্ষক-চিকিৎসকরাই নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন। অভিযোগ, নির্মলের নির্দেশে তাঁরা সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। এমনিতে পরীক্ষা চলাকালীন শৌচাগারে ঢুকে চিরকুট বের করে প্রশ্নের উত্তর লেখার একটা রেওয়াজ রয়েছে। এ দিন পরীক্ষাকেন্দ্রের মধ্যেই রসিকতা শুরু হয়ে যায়, ‘এ বার আর কাউকে বাইরে বেরোতে হবে না। সবটাই বসে বসে পাওয়া যাবে।’

কেপিসি-র এক পরীক্ষার্থী ছাত্রীর কথায়, ‘‘বেঞ্চ টেনে এ-ওর পাশে হুমড়ি খেয়ে টোকা হচ্ছিল। আমরা কয়েক জন প্রতিবাদ করলেও স্যারেরা কেউ গ্রাহ্য করেননি।’’

শেষমেশ মেডিক্যালেরই এক দল জুনিয়র ডাক্তার এসে বাধা দেন। সেই বচসাই শেষ পর্যন্ত মারামারিতে পর্যবসিত হয় বলে অভিযোগ।

মেডিক্যালের জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনের নেতা রৌনক হাজারি বলেন, ‘‘আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, খুব ঝামেলা চলছে। এসএসকেএমের সৌমাভ চট্টোপাধ্যায়কে খুব মারধর করা হয়েছে। এসএসকেএমেরই তৃণমূল ছাত্রনেতা শুভজিৎ দত্ত ছুটে পালাচ্ছেন। আমরা ছাড়ানোর চেষ্টা করি।’’ কেন এমন হল? রৌনক বলেন, ‘‘শুনেছি, এসএসকেএমের ডাক্তাররা ক্যালেন্ডার বিলির নামে হল-এ ঢুকে টোকাটুকিতে সাহায্য করছিলেন। তবে এটা গুজবও হতে পারে।’’ রৌনকের এক সতীর্থ বলেন, ‘‘পরীক্ষা দেওয়ার সময়ে পড়ুয়ারা অ্যাপ্রন পরে থাকেন। চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য এ দিন যাঁরা টোকাটুকিতে সাহায্য করতে এসেছিলেন তাঁরাও অ্যাপ্রন পরেছিলেন।’’

উল্টো দিকে সৌমাভ টোকাটুকিতে সাহায্যের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘আমরা নতুন বছরের ক্যালেন্ডার পৌঁছে দিতে মেডিক্যালে গিয়েছিলাম। ওখানে অনেকে আমাদের জনপ্রিয়তাকে ঈর্ষা করেন। তাঁরাই বাগে পেয়ে সে দিন আমাদের আক্রমণ করেছেন।’’

শুভজিতের অভিযোগ, ‘‘রৌনক বহিরাগত দুষ্কৃতী নিয়ে আমাদের উপরে চড়াও হয়েছিলেন।’’ কিন্তু ওঁরা সকলেই তো তৃণমূল সমর্থিত ইউনিয়নের সদস্য! তা হলে কি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই এ ক্ষেত্রে বড় হয়ে উঠল? সৌমাভ এর কোনও জবাব দেননি। শুভজিৎ বলেন, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নয়। ভুল বোঝাবুঝি।’’

মঙ্গলবার টোকাটুকির এই ঘটনা নিয়ে থানা-পুলিশ হওয়ার পরে বুধবার মেডিসিন দ্বিতীয় পত্রে আর বাইরে থেকে ছেলে আনিয়ে ‘সাহায্য’ করার ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। মেডিক্যালের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষকদের একাংশের অভিযোগ, বুধবার নির্মল মাজির-ঘনিষ্ঠ কিছু শিক্ষকই পরীক্ষার হল-এ গিয়ে উত্তর বলে দিয়েছেন।

পরীক্ষার্থী এক ছাত্রের কথায়, ‘‘মেডিসিন দ্বিতীয় পেপারের দিন আমাদের কিছু সহপাঠী অতি সহজ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নও লিখতে পারছিলেন না। তখন কয়েক জন স্যার এসে সেগুলো বলে দিয়ে গিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে মুখ খুললে দেখে নেওয়া হবে বলে তৃণমূল ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা শাসিয়ে যান।’’

অভিযোগের আঙুল উঠেছে বিভাগের প্রধান চিকিৎসক রথীন্দ্রনাথ সরকারের বিরুদ্ধে। তিনি নাকি দু’বার হল-এ গিয়ে কিছু পরীক্ষার্থীকে একাধিক সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়েছেন। রথীন্দ্রবাবুর নিজের যদিও দাবি, ‘‘প্রশ্নের কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আমি দু’বার গিয়েছিলাম। কয়েক জন উত্তর জানতে চায় ঠিকই। কিন্তু আমি উত্তর বলতে যাব কেন?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন