কেশরীর চাপে বেদম চটেও রূপার জন্য পুলিশি নিরাপত্তা

রাজভবনের ইচ্ছে। তাই যতই না-পসন্দ হোক, সম্মানের খাতিরে মানতে হচ্ছে নবান্নকে। নিজের অন্দরে ক্ষোভের গজরানিও চলছে। বিজেপি নেত্রী তথা অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে সর্বক্ষণের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দিতে নবান্নকে সুপারিশ করেছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। আর তাতেই বেজায় চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী শিবিরে তাঁর বিরুদ্ধে যিনি সবচেয়ে মুখরা, সেই নেত্রীর সুরক্ষায় তাঁরই সরকার কিনা পুলিশ দেবে!

Advertisement

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪০
Share:

রাজভবনের ইচ্ছে। তাই যতই না-পসন্দ হোক, সম্মানের খাতিরে মানতে হচ্ছে নবান্নকে। নিজের অন্দরে ক্ষোভের গজরানিও চলছে।

Advertisement

বিজেপি নেত্রী তথা অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে সর্বক্ষণের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দিতে নবান্নকে সুপারিশ করেছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। আর তাতেই বেজায় চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী শিবিরে তাঁর বিরুদ্ধে যিনি সবচেয়ে মুখরা, সেই নেত্রীর সুরক্ষায় তাঁরই সরকার কিনা পুলিশ দেবে!

পাশাপাশি যুক্তিও সাজাচ্ছে রাজ্য সরকারের উঁচু মহল। তাদের বক্তব্য, আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি পুরোপুরি রাজ্য প্রশাসনের এক্তিয়ারে। আর রাজ্যপাল হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। তাই এ ব্যাপারে তাঁর বলার কিছু থাকতে পারে না। ‘‘তা ছাড়া যিনি (রূপা) নিজেই নানা জায়গায় গিয়ে আইন-শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন, তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়ার অর্থ কী?’’— প্রশ্ন তুলেছেন নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা।

Advertisement

‌কিন্তু ঘটনা হল, বিজেপি নেত্রীকে রক্ষী দেওয়ার জন্য তদ্বির করেছেন স্বয়ং রাজ্যপাল। তা-ও একাধিক বার! ফলে প্রশ্ন-যুক্তি-আপত্তি যতই থাক, রাজ্যপালের সম্মানরক্ষার্থে শেষমেশ রূপাকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দিতে রাজি হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে ন্যূনতম সংখ্যায়। পুলিশ চেয়েছিল রূপার জন্য সর্বক্ষণের দু’জন রক্ষীর বন্দোবস্ত করতে। মমতার নির্দেশ, এক জন থাকলেই হবে।

নেপথ্য কাহিনিটা কী?

রাজভবনের খবর: ক’দিন আগে হাবরা-অশোকনগরে বন্যা দুর্গতদের শিবির দেখতে গিয়ে রূপা বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। ফিরে এসে রাজভবনে গিয়ে নিজের সেই ‘অভিজ্ঞতা’ তিনি লিখিত ভাবে জানান রাজ্যপালকে। পুলিশের সামনেই কী ভাবে তাঁকে হেনস্থা, গালিগালাজ ও আব্রু নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেন। রাজভবনের দরবারে রূপার অভিযোগ— স্বাধীন নাগরিক হিসেবে রাজ্যের যে কোনও জায়গায় যাওয়ার অধিকার তাঁর থাকলেও তাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। শাসকদলের গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণে তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ‘‘আপনি যে হেতু রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, তাই আপনার কাছেই প্রতিকার চাইছি।’’— রাজ্যপালকে বলেছেন বিজেপি নেত্রী।

জানা গিয়েছে, রাজ্যপাল নিজস্ব কিছু সূত্র মারফত খোঁজ-খবর চালিয়ে অভিযোগের ভিত্তি খুঁজে পান। তার পরে রূপার অভিযোগপত্রটি তিনি রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে পাঠিয়ে অবিলম্বে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে বলেন। প্রশাসন কী করল, সে বিষয়ে তাঁকে অবহিত করা হবে বলেও তখন আশা প্রকাশ করেছিলেন কেশরীনাথ। বেশ কিছু দিন বাদেও সরকার ব্যবস্থা না-নেওয়ায় তিনি পুলিশ প্রধানকে টেলিফোন করেন। জানতে চান, এত দেরি হচ্ছে কেন?

রূপা-রক্ষায় কেশরীনাথের এ হেন তৎপরতার ব্যাখ্যাও শোনা গিয়েছে রাজভবন-সূত্রে। ‘‘রাজ্যপাল নিশ্চিত হয়েছেন যে, বিজেপি নেত্রীকে নানা জায়গায় যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এরই ভিত্তিতে তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ করেছেন, সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে যা তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।’’— মন্তব্য সূত্রটির।

খোদ রাজ্যপালের তরফে এমন ‘চাপ’ আসায় পুলিশের শীর্ষ মহল নড়ে-চড়ে বসে। নবান্নের খবর: রাজ্যপালের ফোন পাওয়ার পরে ডিজি পুরো বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। জেনে বেজায় চটে যান মুখ্যমন্ত্রী। যদিও রাজ্যপালের অনুরোধের মর্যাদা রাখতে রূপার জন্য সর্বক্ষণের এক জন রক্ষী মোতায়েন করতে তিনি ডিজি’কে নির্দেশ দেন।

সেই মতো পুলিশি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ডিজি’র তরফে কলকাতা পুলিশকে বলা হয়েছে ওই অভিনেত্রীর নিরাপত্তা-পরিস্থিতি যাচাই করতে। কলকাতা পুলিশের এক অফিসার ইতিমধ্যে দক্ষিণ কলকাতায় রূপার বাড়িতে গিয়ে খবরাখবর নিয়ে এসেছেন। ‘‘দিন কয়েকের মধ্যে ওঁর দেহরক্ষী মোতায়েন হয়ে যাবে।’’— বলেছেন নবান্নের এক কর্তা।

কিন্তু রাজ্যপালের সক্রিয়তায় মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ কেন?

নবান্নের বক্তব্য: পুলিশি নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য কারা, রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর তা ঠিক করে। প্রাণহানির আশঙ্কা, হুমকি, গোয়েন্দা-রিপোর্ট ইত্যাদি যাচাই করে সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয় দফতরের অধীনস্থ স্টেট সিকিওরিটি রিভিউ কমিটি। এই পদ্ধতিতে জেড-প্লাস, জেড, ওয়াই (টি), ওয়াই, এক্স প্রভৃতি শ্রেণিতে নিরাপত্তার স্তরবিন্যাসও হয়। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালও পদ্ধতিটির ব্যতিক্রম নন। এবং এই প্রেক্ষাপটেই রূপা-পর্বে অনিয়মের ছায়া দেখতে পেয়েছেন মমতা। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁর প্রশ্ন— যেখানে রাজ্যপাল বা মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশি নিরাপত্তার বহর নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে নির্ধারিত হয়, সেখানে স্রেফ সুপারিশের জোরে কাউকে কী ভাবে দেহরক্ষী দেওয়া সম্ভব?

বিজেপি’র বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে ইদানীং রাজ্যপাল অতিরিক্ত তৎপরতা দেখাচ্ছেন বলেও মনে করছে প্রশাসনের উঁচু মহল। যার হাতে গরম উদাহরণ নবান্নকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে বিধাননগর ও আসানসোলের পুরভোট এবং শিলিগুড়ির মহকুমা পরিষদের ভোটের জন্য আধাসেনা চেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি লেখা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ভোটের নিরিখে বিধাননগর এবং আসানসোল দু’জায়গাতেই শাসক দলের থেকে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। ফলে সেখানে ভোটের সময় আধাসেনা মোতায়েনের দাবি তারা ইতিমধ্যেই তুলেছে। সরাসরি বিজেপির নাম না-করলেও তৃণমূলের অন্দরের অভিযোগ, মূলত বিরোধীদের অনুরোধেই এমন নজিরবিহীন কাণ্ড ঘটিয়েছেন ত্রিপাঠী। কেন্দ্র নিয়মমাফিক রাজ্যপালের আর্জি খারিজ করে দিলেও নবান্নের এক কর্তার আক্ষেপ, ‘‘রাজভবন কোনও বিশেষ দলের সালিশি কে‌ন্দ্র হয়ে দাঁড়ালে সেটা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক।’’

যাঁকে নিরাপত্তা দেওয়াকে কেন্দ্র করে এত কিছু, তাঁর কী প্রতিক্রিয়া?

রূপার দাবি: রাজ্য প্রশাসনের অভিভাবক হলেন রাজ্যপাল। তাই শাসকদলের গুণ্ডাবাজির বিরুদ্ধে কেশরীনাথের দ্বারস্থ হয়ে তিনি উচিত কাজই করেছেন। ‘‘পুরভোটের মুখে গোপালনগরে কী হয়েছিল, সকলে দেখেছেন। পরে পাড়ুই, হাবরা, অশোকনগর— যেখানে গিয়েছি, আমাকে ঘিরে বিক্ষোভ, আক্রমণ হচ্ছে। পুলিশ কিছু বলছে না। গণতন্ত্রে এ জিনিস চলতে পারে না।’’— বলেন রূপা। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, ইদানীং নেত্রীর বাড়িতে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে। অনেকে বিজেপি কর্মী পরিচয় দিয়ে সকাল থেকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। এমনকী, সম্প্রতি এক ব্যক্তি ওখানে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ। এ সবের মধ্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বিজেপি নেত্রী। এমতাবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে এক জন দেহরক্ষী মঞ্জুর করেছেন শুনে রূপার মন্তব্য, ‘‘এক অফিসার এসে অনেক কিছু জেনে গিয়েছেন। রক্ষী দেওয়া বড় নয়। বিরোধী কণ্ঠ যাতে রুদ্ধ না হয়, মুখ্যমন্ত্রী সেটা নিশ্চিত করুন।’’

তবে বিজেপি নেত্রীর নিরাপত্তা প্রসঙ্গে ওঁর নিজের ঘরেও বিতর্ক রয়েছে। রাজ্য বিজেপি’র ক্ষমতাসীন অংশের অনেকের মতে, রূপার সুরক্ষা নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এই মহলের যুক্তি, নিরাপত্তা জরুরি হলে কেন্দ্রই ব্যবস্থা করত। যে ভাবে রাহুল সিংহ বা বাবুল সুপ্রিয়র সুরক্ষায় সিআরপিএফ মোতায়েন হয়। ‘‘তাঁরা কেউই কিন্তু রাজ্যপাল মারফত পুলিশি নিরাপত্তা চাননি।’’— কটাক্ষ করেছেন এক বিজেপি নেতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন