নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ছোট্ট শরীরটা। নিউমোনিয়া সারিয়ে সে যখন বাড়ি ফিরবে, তার নামের পাশে সারা জীবনের জন্য লেখা হয়ে থাকবে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’!
আড়াই মাসের অঙ্কুর শীট জানতেই পারল না, তার ডান হাত কখন বাদ চলে গেল! বড় হয়ে যখন বুঝবে, তখন কী করবে, কী ভাবে জীবন চালাবে— ভেবেই পাচ্ছেন না শিশুটির বাবা-মা।
এই ঘটনায় গাফিলতির আঙুল উঠেছে যে হাসপাতালের বিরুদ্ধে, সেই আসানসোল মহকুমা হাসপাতালের সুপার-সহ শিশু বিভাগে অঙ্কুরের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা মোট ছ’জন ডাক্তার-নার্সকে শো-কজ করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং অপরাধ প্রমাণের পরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যাপারে যাতে টালবাহানা না হয়, সে ব্যাপারেও বুধবার বিকেলে স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তাদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ঠিক কী গাফিলতি হয়েছে?
রানিগঞ্জের বল্লভপুরের বাসিন্দা, অস্থায়ী বাসকর্মী জয়ন্ত শীটের ছেলে অঙ্কুরকে নিউমোনিয়া নিয়ে ২৬ জানুয়ারি এলাকার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছিল। সে দিনই তাকে পাঠানো হয় আসানসোল হাসপাতালে। ওই দিন বিকেলে রক্ত নেওয়ার আগে হাতের শিরা ফোলানোর জন্য অঙ্কুরের ডান হাতে রবারের নল (টুর্নিকেট) বাঁধা হয়েছিল। রক্ত নেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তা খুলে দেওয়ার কথা। অভিযোগ, টানা দু’দিন ওই শিশুর হাতে কষে সেই টুর্নিকেট বাঁধা ছিল। হাসপাতালের অত জন চিকিৎসক, নার্স কারও তা নজরে পড়েনি। চিকিৎসকেরা রাউন্ডে এসেও খেয়াল করলেন না, শিশুর ডান হাত কালো হয়ে যাচ্ছে!
২৮ তারিখ বিষয়টি নজরে পড়তেই অঙ্কুরের বাড়ির লোক দায়িত্বে থাকা নার্সকে জানান। অভিযোগ, তখনও হেলদোল না-দেখিয়ে তিনি একটা মলম ধরিয়ে দেন। মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারি এসএসকেএম হাসপাতালে শিশুটির কালো হয়ে যাওয়া ডান হাত কনুইয়ের নীচ থেকে অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হল! চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন, দু’দিন ধরে ওইটুকু হাতে শক্ত করে টুর্নিকেট বাঁধা থাকায় কনুইয়ের নীচে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল! অর্থোপেডিক্স ও পেডিয়াট্রিক সার্জারির যে চিকিৎসক দল ওই অস্ত্রোপচার করেছে, তার এক সদস্যের কথায়, ‘‘মনে হচ্ছে, আসানসোল হাসাপাতালে ওই দু’দিন শিশুর ধারেকাছেই কোনও চিকিৎসক বা নার্স যাননি।’’
সরকারি হাসপাতালে রোগীদের প্রতি পরিষেবাদাতারা কতটা দায়সারা হলে এ রকম হতে পারে, অঙ্কুর-কাণ্ডের পরে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে স্বাস্থ্যভবনে। কয়েক মাস আগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ওয়ার্মারে দুই সদ্যোজাতের পুড়ে মৃত্যুর ঘটনার পরে স্বাস্থ্যকর্তারা বলেছিলেন, এটা অঘটন ও অনিচ্ছাকৃত।
এই ঘটনার পরে অবশ্য অন্য সুর! রাজ্যে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যে নজরদারির জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘একে ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে ফেলা যায়। এর অজুহাত হয় না। কোনও ক্ষমাও হয় না।’’ স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর বক্তব্য, ‘‘দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক-নার্সের চরম গাফিলতি হয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। কঠোরতম শাস্তি হবে। দ্বিতীয়বার রাজ্যের কোনও হাসপাতালে যেন এমন দুঃখজনক ঘটনা না ঘটে, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার বিষয়টি জানতে পারেন। তার পর একাধিক বার তিনি শিশুটির খোঁজ নিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, শিশুর মা হাসপাতালে তার সঙ্গে ছিল। তিনিও কি খেয়াল করেননি?
আসানসোল হাসপাতালের সুপার নিখিল দাস কিন্তু মানছেন, বাড়ির লোক কেন খেয়াল করেননি, তার থেকেও বড় কথা হল চিকিৎসক-নার্সরা কেন দেখলেন না। তাঁর কথায়, ‘‘মর্মান্তিক। আমি কোনও কিছু মেলাতে পারছি না। ওয়ার্ডে সব সময় ৬-৭ জন ডাক্তার, ৪-৫ জন নার্স থাকেন। তাঁরা তা হলে কী করেন!’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘অভিযুক্ত ডাক্তারবাবু আশিসকুমার ঘোষকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী করলেন! উনি বললেন, স্যার বুঝতে পারিনি!’’